সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আপনারা আগেও প্রশ্ন করেছেন। সেই উত্তরও পুনরাবৃত্তি করি। এটি অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।
তিনি আরও বলেন, যখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে এবং তার জন্য যেকোনো প্রক্রিয়ায় হতে পারে।
আজ সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি এমন তথ্য জানান।
শেখ হাসিনা অবস্থান করলেও তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে ঢাকাকে দিল্লি আশ্বস্ত করেছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
লিখিত বক্তব্যে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘আপনারা জানেন যে, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই প্রেক্ষিতে কনসালটেশনসে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সামনের দিনে আরো এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।’’
দুই পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নিকট আমরা আমাদের দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সকল অনিষ্পন্ন বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করি। আমি দুই দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দিই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।’’
ভারতীয় গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব নিয়ে অপতথ্য প্রচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তী সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান রয়েছে; সে বিষয়ে আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছি। সেই সাথে আমরা জোর দিয়ে বলেছি, বাংলাদেশে বসবাসরত সব ধর্ম নির্বিশেষে স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছে এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের সুযোগ নেই।’’
সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসতে বিদেশি সাংবাদিকদের আহ্বান জানানো হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ‘‘সেই সাথে আমরা এও বলেছি যে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়। আমি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিৎ।’’
সীমান্ত হত্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা অবগত রয়েছেন যে, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি জীবন মূল্যবান। এই লক্ষ্যে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অনুরোধ করেছি। তাছাড়া, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাই।’’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘আজকের আলোচনায় আন্তঃনদী বিষয়সমূহ গুরুত্ব পেয়েছে। আমি তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিই। গঙ্গা-পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। সে প্রেক্ষিতে তা নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিই। এ ছাড়াও, আরো যে কয়টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাধীন, সেসব সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ জোর দিই। বন্যা পূর্বাভাস, উপাত্ত ও ডাটা আদান-প্রদানসহ বন্যা প্রতিরোধে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি এবং এ বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের মেকানিজম গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করি।’’
দুই দেশের বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ভারত আমাদের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের সাথে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফের মত বাধাসমূহ দূর করার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি।’’
পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, ‘‘আপনারা জানেন যে বর্তমানে ভারতের সাথে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত হতে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।’’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার কথাও জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। পাশাপাশি বৈঠকে ভারতের ভিসা ইস্যুটিও গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানান তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘প্রতি বছর পর্যটন এবং চিকিৎসা উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করে। তাদের ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার ইস্যু সহজীকরণের জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। যেসকল বাংলাদেশি নাগরিক ভারতের আদালতের দেওয়া সাজা বাংলাদেশে অথবা ভারতে ভোগ করছে, তাদের সাজা মওকুফের বিষয়ে ভারতের যথাযথ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া, ভারতে আটক বাংলাদেশের জেলেদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’’
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করার বিষয়ে ভারত সরকারের দৃঢ়তা তুলে ধরেছেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘‘আপনারা জানেন ফরেন অফিস কনসালটেশন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমরা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে এফওসির সর্বশেষ বৈঠক নয়াদিল্লিতে করেছিলাম। এই প্রেক্ষিতে, উভয় দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের চলমান সহযোগিতামূলক কার্যক্রমসমূহের বিষয়ে আজকের এফওসিতে করা সার্বিক আলোচনা বা পর্যালোচনা পরবর্তীতে বিষয়সমূহকে এগিয়ে নিতে বা আমাদের প্রাধিকারমূলক ইস্যুগুলোতে পারস্পরিক সদিচ্ছা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে সমাধান করতে অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।’’