বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে থামছে না নারী কেবিন ক্রুদের যৌন হয়রানি। পাইলটদের বিরুদ্ধে ফের উঠেছে এ ধরনের অভিযোগ। এসব ঘটনা ঘটছে চলন্ত বিমানের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা ককপিটে।
এর আগে ২০১৯ সালেও বড় ধরনের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। যদিও সে ঘটনার দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি। একের পর এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির শিকার হলেও অনেকটা নীরব বিমান কর্তৃপক্ষ। নারী কেবিন ক্রুদের অভিযোগ, বিমানে যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে প্রতিকার পাওয়া যায় না। কিছু ক্ষেত্রে উল্টো হয়নারির শিকার হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছেন কেবিন ক্রুরা। আর চাকরি রক্ষায় প্রতিবাদ করার সাহসও পাচ্ছেন না তারা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিমানের ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা ও জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা এবং ঢাকা-মাসকাট-ঢাকা ফ্লাইটে দুজন নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হন। তারা দুজনই প্রতিকার চেয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
• গত ৩ নভেম্বর মাসকাটগামী ফ্লাইটে নারী কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানি করেন এক পাইলট
• ১০ নভেম্বর জেদ্দাগামী ফ্লাইটেও এক পাইলট নারী কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানি করেন
• আলাদা দুটি ঘটনা তদন্ত করছে বিমান
• ককপিটে যৌন হয়রানির দৃশ্যমান শাস্তি চান অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রশাসন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১৪ নভেম্বর বিমানের সিইও বরাবর এক পাইলটের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং অপেশাদারমূলক আচরণের অভিযোগ করেন ফ্লাইট সার্ভিস উপ-বিভাগে এক কেবিন ক্রু।
অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ নভেম্বর বিজি-১৩৫ নম্বর ফ্লাইট (ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা) অপারেট করেন ওই নারী কেবিন ক্রু। ফ্লাইটে অপারেটিং পাইলট ছিলেন মুনতাসীর ও আবেদ। ফ্লাইটের মাঝামাঝি সময় তারা ওই নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডাকেন। কুশলবিনিময়ের একপর্যায়ে পাইলট আবেদ তার সঙ্গে অপেশাদারমূলক (ব্যক্তিগত) কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীসময়ে ককপিটের দরজার সামনে তাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেকও করতে চান।
পরে গত ১২ নভেম্বর ফিরতি ফ্লাইটে (বিজি-২৩৬ জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা) এই কেবিন ক্রুর ‘ওয়ার্কিং পজিশন’ ছিল সামনে। এ কাজের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ককপিটে যেতে হয়। তখন পাইলট আবেদ কৌতুক শোনানোর ছলে তাকে বাংলা ব্যাকরণ (কারক, সমাস, লিঙ্গ পরিবর্তন) নিয়ে কথা বলেন। এক পর্যায়ে আবেদ লিঙ্গ পরিবর্তন ও ধাতু নিয়ে কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল মন্তব্য করেন। এছাড়া নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও করেন বলে অভিযোগ। ওইদিন রাতেই বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর ইমেইলে পাইলট আবেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই নারী কেবিন ক্রু।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাইলট আবেদের হোয়াটঅ্যাপ নম্বরে রোববার (১ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাংবাদিক পরিচয়ে কল দিয়ে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ কেটে দেন। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে লিখিত বক্তব্য চাওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক নারী কর্মকর্তা বলেন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিমূলক আচরণে চরমভাবে চিন্তিত ও অনিরাপদ বোধ করছেন নারী কেবিন ক্রুরা। বিমান কর্তৃপক্ষকে নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মাসকাটগামী ফ্লাইটেও যৌন হয়রানি
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-মাসকাটগামী ফ্লাইটেও এক পাইলটের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনাটিও ঘটেছে বিমানের ককপিটে। যেখানে সিসি ক্যামেরা নেই। পাইলটের অনুমতি ছাড়া কেবিন ক্রুদেরও প্রবেশের সুযোগ নেই।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, গত ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে মাসকাটগামী বিজি ৭২১ নম্বর ফ্লাইট ছেড়ে যায়। এই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ইউসুফ মাহমুদ। তিনিও এক নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডেকে যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ। এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর অভিযোগ দেন ওই নারী কেবিন ক্রু। লিখিত অভিযোগে ওই নারী জানান, মাসকটগামী ফ্লাইটে পাইলট ইউসুফ ওই নারী কর্মীকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করেন এবং জোর করে কমলা খাইয়ে দেন।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিমানের ককপিটে কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানির ঘটনা অপ্রত্যাশিত। এটা পাইলটদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আকাশপথে এ ধরনের কর্মকাণ্ড খুবই বিপজ্জনক।’
তিনি বলেন, ‘নিরাপদে ভ্রমণের জন্য সবাই আকাশপথ বা ফ্লাইট বেছে নেয়। সেখানে শুধু জান-মাল নয়, সব ধরনের নিরাপত্তা চায় যাত্রীরা। ফ্লাইটে নারী কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানি দুঃখজনক। তদন্তের মাধ্যমে অপরাধী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।’
মাসকাটগামী ফ্লাইটের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান। এই কমিটির প্রধান বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম। জানতে চাইলে বোসরা ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌন হয়রানির ওই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। আশা করি এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। তদন্তের কাজ চলাকালীন এ বিষয়ে মন্তব্য করবো না।’
এর আগে ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে ককপিটে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন একাধিক নারী কেবিন ক্রু। বিমানের জ্যেষ্ঠ পাইলট ইশরাত আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তখন এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে এসব ঘটনায় দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। ককপিটে পাইলটদের সব সময় ফ্লাইট পরিচালনায় সতর্ক থাকতে হয়। অথচ সেখানে ওই ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা দুঃখজনক বলে মনে করেন অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে বিমানের এমডি সাফিকুর রহমান বলেন, ‘বিমানের আলাদা ফ্লাইটে দুই নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আমরা বিষয় দুটি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তথ্যসূত্র: জাগো নিউজ