বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বাণিজ্য সম্পর্ক কেমন, আমদানি-রপ্তানি হয় কী পণ্য?

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৩ দিন আগে
সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টি নতুন করে আলোচনা এসেছে। গবেষক ও আমদানি-রপ্তানির সাথে জড়িতরা অনেকে মনে করছেন ভৌগলিক দূরত্বের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরো বাড়ানো ও সহজ করার সুযোগ আছে।

তারা বলছেন সরাসরি জাহাজ ও বিমান চলাচল চালুর পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, উভয় দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণ এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত পারস্পারিক বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বাণিজ্য কয়েকগুণ বাড়ানো যাবে, যাতে উভয় দেশ সমভাবে লাভবান হতে পারে।

যদিও বহুদিন ধরেই দুই দেশের মধ্য আমদানি-রপ্তানি রয়েছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বাণিজ্য আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য একটি যৌথ কারিগরি দল গঠন করা যেতে পারে এবং এর মাধ্যমে বিনিয়োগভিত্তিক বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরির সুযোগ তৈরি হতে পারে।’

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো আইনুল ইসলাম বলেন, ‘পাকিস্তানের তরফ থেকে বাংলাদেশিদের বিনা ভিসায় পাকিস্তান সফরের ঘোষণা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের সুযোগ এনে দিয়েছে।’

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এবারই প্রথমবারের মতো সরাসরি জাহাজ করাচি থেকে চট্টগ্রাম আসলো।

এমন প্রেক্ষাপটেই অনেকে আলোচনা করছেন দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরো বাড়ানো যায় কি-না কিংবা বর্তমান বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনে কীভাবে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে।

কী ধরণের পণ্যের বাণিজ্য হচ্ছে
করাচি থেকে বাংলাদেশে সরাসরি আসা যে জাহাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই জাহাজে বাংলাদেশে এসেছে ‘ফেব্রিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট ও ডলোমাইট’, যার বেশিরভাগই টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল।

পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল প্রায় ৭৯ শতাংশ।

বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মূল্য ছিলো ৬ কোটি ডলারের সামান্য বেশি। মূলত কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিলো বাংলাদেশ।

এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭৪ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করলেও পাকিস্তান থেকে আমদানি করেছে ৮৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য পাকিস্তানের রপ্তানি হয়, তার দশগুণ বেশি পাকিস্তান বাংলাদেশে রপ্তানি করে।

পাকিস্তান থেকে গত বছর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে তুলা। এছাড়া আরো যেসব পণ্য আসে বাংলাদেশে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আসে সিমেন্টের কাঁচামাল।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় এমন যেসব পণ্যের নাম দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে-পাট ও অন্য টেক্সটাইল ফেব্রিকস, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, পেপার ও পেপারবোর্ড লেবেল, ছেলেদের শার্ট, মেডিক্যাল সার্জিক্যাল ও ডেন্টাল ইকুইপমেন্টসহ আরো কয়েকটি পণ্য।

ড. আইনুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য, গার্মেন্ট, মেডিসিন, লেদার – এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানে রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিলিং ফ্যান, ফ্রুটস, জুস, মেয়েদের ড্রেস বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কস্ট বেনিফিট পর্যালোচনা করে আমদানি-রপ্তানির পণ্য ঠিক হলে উভয় দেশই তাতে লাভবান হবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, উভয় দেশের মধ্যে কোন ধরনের পণ্যের কেমন চাহিদা, সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। পাকিস্তান থেকে কটন বা টেক্সটাইল কাঁচামাল সম্ভাব্য পণ্য হতে পারে যা মূলত ভারত ও চীন থেকেই বেশি আসে। আবার পাকিস্তানের লাইট ইনজিনিয়ারিং পণ্যের ভালো সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশে।

তার মতে বিনিয়োগকারীরা উভয় দেশে চাহিদার ভিত্তিতে যৌথ বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশে ঔষধ ও গার্মেন্টস কারখানা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অঞ্চলে করতে পারে। এর ফলে পাকিস্তান ছাড়াও ইরানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর বাজারে প্রবেশ সহজ হতে পারে।

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আরিফ আহমেদ বলছেন, এক সময় বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত দ্রব্যের প্রচুর চাহিদা ছিলো পাকিস্তানে। সেটি এখন তেমন না থাকলেও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আসছে। আমাদেরও গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন পণ্য অল্প হলেও যাচ্ছে।

হঠাৎ বাণিজ্য আলোচনায় কেন
বাংলাদেশে গত পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনার আহমদ মারুফ নতুন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে সাক্ষাত করে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

এসব সাক্ষাতে তিনি পারস্পারিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে সরাসরি ফ্লাইট চালুর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতে তিনি গত পনের বছরে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে শুষ্কতা এসেছে তা দূর করতে পারস্পারিক সম্পর্ক জোরদারের আহ্বান জানান। এর মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমানের সাথেও বৈঠক করেন তিনি।

যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, যৌথ বিজনেস কাউন্সিল, উভয় দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণ, হালাল খাদ্য আমদানি-রপ্তানি, এসএমই, ফার্মাসিউটিক্যাল এবং অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় বলে জানানো হয়েছিলো।

তবে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যের বিষয়টি বড় ধরনের আলোচনায় আসে করাচি থেকে সরাসরি বাংলাদেশে জাহাজ আসার খবরে।

পাকিস্তান হাই কমিশন গত ১৩ নভেম্বর তাদের ভেরিফায়েড এক্স (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে এটিকে ‘দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।

ওই টুইটে তারা বলেছে, এই ‘নতুন রুট সরবরাহ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মাঝে আনবে, ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ খুলে দিবে’।

গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ভৌগলিক দূরত্ব ও সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় দুই দেশের বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়নি। এখন বাংলাদেশের পণ্য পাকিস্তানে যেতে হলে দুবাই বা শ্রীলংকা হয়ে করাচি যায়। আবার কখনো করাচি থেকে দুবাই কলম্বো হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে। এর ফলে বাণিজ্য ব্যয় বৃদ্ধি পায় ও সময় বেশি লাগে। স্বাভাবিক বাণিজ্য এতে বাধাগ্রস্ত হয়।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলে পাকিস্তান থেকে আসা পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে অনুমোদন পেলেই কেবল ছাড় দেওয়া হতো। বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর সেই বিধান তুলে নিয়েছে। এতে পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি দ্রুত হবে এবং জটিলতাও কাটবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলছেন, ব্যবসায়ীদের দাবি হলো সরাসরি জাহাজ চলাচল এবং এটি হলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরো অনেক বাড়বে। তখন বাংলাদেশও তার পণ্য রপ্তানি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবে।