পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
‘উত্তর-দক্ষিণ ভেদাভেদ’ নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ললাটে যেন এক কলঙ্ক তিলক। গত ৪ দশক ধরেই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শহরভিত্তিক রাজনীতিতে দুই মেরুর ভেদাভেদ জিইয়ে আছে। এই উত্তর-দক্ষিণ ভেদাভেদ এখানকার রাজনীতিকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, স্থানীয় সরকারের যেকোনো ভোটের নির্বাচন কিংবা জেলা ও মহানগরের নেতৃত্ব নির্বাচনেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মূলত ৪ দশকের কিছু বেশি আগে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক প্রয়াত একেএম সামসুজ্জোহা এবং সাবেক পৌর পিতাখ্যাত প্রয়াত আলী আহাম্মদ চুনকা থেকে সেই বিভেদ বংশানুক্রমিকভাবে এখনো চলমান; যা স্থানীয় রাজনীতিতে পরিচিতি পেয়েছে ‘উত্তর-দক্ষিণ’ হিসেবে।
এই ‘উত্তর-দক্ষিণের’ এক মেরুতে আছেন প্রয়াত সামসুজ্জোহার ছেলে এমপি শামীম ওসমান ও অপর মেরুতে চুনকা তনয়া মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। তাদের এই পরিবারভিত্তিক ভেদাভেদকে কেউ দেখেন নেতৃত্বের আধিপত্য নিয়ে কোন্দল আবার কেউ দেখেন দলের ভেতরে ও বাইরের মধ্যসত্ত্বভোগীদের ‘সফল ষড়যন্ত্র’ হিসেবে।
খোদ দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এই দুই নেতাকে ‘জেলার শক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও শামীম-আইভী ঐক্য আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সম্ভাব্যতার চেয়ে নেতিবাচকই মনে করেন দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে তারা মনে করেন, শামীম ওসমানের মতো মেয়র আইভীও যদি মাঠ ও রাজপথের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠতেন তবে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী রূপ পেত।
দলের একাধিক প্রবীণ কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের সদস্যরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকেই শামীম ওসমানের দাদার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ‘বায়তুল আমান’-এ যাতায়াত ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানীসহ অনেক প্রয়াত জাতীয় নেতার। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতির ধারকবাহক বলতে ওসমান পরিবারকেই বোঝানো হতো। সম্প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রী শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধনকালে প্রয়াত খান সাহেব ওসমান আলী ও তার বাসভবনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অপরদিকে আলী আহাম্মদ চুনকা বন্দরের একটি পাটকলে শ্রমিক নেতা হিসেবে ওই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং তিনি বিডি মেম্বারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রয়াত একেএম সামসুজ্জোহার সঙ্গে আলী আহাম্মদ চুনকার বিভেদের শুরু ১৯৭৪ সালের (বিলুপ্ত) পৌর নির্বাচনকে ঘিরে। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে চুনকা জয়লাভ করলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের অপর প্রভাবশালী নেতা খোকা মহিউদ্দিন; যাকে সমর্থন দিয়েছিলেন একেএম সামসুজ্জোহা।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরপরই গ্রেফতার করা হয় একেএম সামসুজ্জোহাকে। তিনি গ্রেফতার হয়ে প্রায় ৪ বছর জেলে ছিলেন এবং ওই সময় আলী আহাম্মদ চুনকা শহরে তার প্রভাব বিস্তারে ফাঁকা মাঠ পেয়ে যান। এরপর ১৯৮৪ সালের পৌর নির্বাচনে পুনরায় চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন আলী আহাম্মদ চুনকা। তবে ওই নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে হয় চুনকাকে। আর জয়ী প্রার্থী নাজিম উদ্দিন মাহামুদকে সমর্থন দেয় ওসমান পরিবার। নির্বাচনের কয়েকদিন পরই মৃত্যুবরণ করেন আলী আহাম্মদ চুনকা।
চুনকা পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানান, আলী আহাম্মদ চুনকার মৃত্যুর পর রাজনৈতিক বিভেদটি পারিবারিক বিভেদের বীজ বপন করে। যদিও জীবিত অবস্থায় জোহা ও চুনকার মাঝে নেতৃত্বের বিরোধ থাকলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুজনের মধ্যে চমৎকার সামাজিকতা ও মিল ছিল; যা এখন তাদের দুই উত্তরসূরিদের মাঝে নেই।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেড় যুগের প্রবাস জীবন থেকে ফিরে সেলিনা হায়াত আইভী ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় চেয়ারম্যান পদে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আওয়ামী লীগের সেই ক্রান্তিকালে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে আইভীর জন্য ‘উত্তর-দক্ষিণ’ ভেদাভেদ ভুলে উভয় মেরুর নেতাকর্মীরা জয় ছিনিয়ে আনেন। কিন্তু পৌরসভা (বিলুপ্ত) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের পারিবারিক বিরোধ আবারো রাজনীতির মাঠে সামনে আসে।
ওই সময় জেলা যুবলীগের সম্মেলন, শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুইপক্ষের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। যার রেশ পড়ে ২০১১ সালের প্রথম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে শামীম ওসমানকে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আইভী। ওই নির্বাচনে মেয়র আইভীর প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট ছিলেন বামপন্থী নেতা রফিউর রাব্বি।
২০১৩ সালে রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে চূড়ান্ত বিরোধে জড়ান শামীম-আইভী। এই হত্যাকাণ্ডে মেয়র আইভী প্রকাশ্যে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের ওপর অভিযোগ তোলেন। শামীম ওসমানও পালটা অভিযোগ ও বক্তব্য দেন মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ আর পালটা বক্তব্যের মধ্যে একাত্তর টিভির একটি টক শোতে অংশ নেন শামীম-আইভী। সেখানে ‘অফলাইনে’ দুইজনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়, যা পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।সেই থেকে গত ৯ বছরে মেয়র আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যকার ঐক্য যেন অসম্ভবই মনে হয়েছে সবার।
সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শামীম ওসমান তার বক্তব্যে মেয়র আইভীকে আদরের ছোটবোন বলে সম্বোধন করলেও আইভীর বক্তব্যে ছিল বিরোধের সুর। সম্মেলনে নেতাকর্মী-সমর্থকদের স্লোগান দেওয়া নিয়ে আইভী ‘ভাইদের স্লোগান’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করেন।
এদিকে শামীম-আইভী ঐক্য আদৌ সম্ভব কিনা, এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে কথা হয় দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবীণ নেতা আবদুল হাই বলেন, শামীম-আইভীর মাঝে ঐক্য করতে আমরা ব্যর্থ। একমাত্র নেত্রীই পারেন তাদের এক করতে।
তবে শামীম ওসমান ও মেয়র আইভী একসঙ্গে রাজপথে নামলে দল শক্তিশালী হবে কিনা- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ জানান, শামীম ওসমান রাজপথ থেকে উঠে আসা নেতা। কিন্তু মেয়র আইভী সেই ক্ষেত্রে রাজপথের রাজনীতি থেকে দূরে। সামনে যে কঠিন সময় আসন্ন সেখানে শামীম ও আইভী যদি একসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন, তবে নারায়ণগঞ্জে সরকারবিরোধীদের ‘আস্ফালন’ অসম্ভব হয়ে যেত।
তবে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মনে করেন, শামীম-আইভী একপথে হাঁটা অসম্ভব। তিনি বলেন, জীবনের ৫০টি বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। কর্মী-সমর্থকরা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝে কম। তারা শুধু এতটুকু বোঝে- কালকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে কে দেশে থাকতে পারবে না আর দেশে থেকেও ভালো থাকবে। তাদের (শামীম-আইভী) বিরোধটি আসলে নীতিগত, তাই উভয়ের একপথে চলাটাও কঠিন।
তবে তৃণমূলের কর্মী ও সমর্থকরা মনে-প্রাণে চাচ্ছেন, মেয়র আইভী ও শামীম ওসমান এক মঞ্চে না উঠলেও অন্তত তারা তাদের নির্বাচনি এলাকায় যেন দলীয় সভা-সমাবেশ করেন। তারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত নিয়ে যে ভাষায় এমপি শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কথা বলছেন, সে ভাষায় যদি মেয়র আইভীর মতো নেত্রীও কথা বলেন, তাহলে কর্মীরা আরও বেশী উজ্জীবিত হয়ে উঠবে।