দেশের বাড়িতে এসে ঈশিতা খুশিতে আত্মহারা। কতদিন পর চাচাতো বোন টুনির সাথে দেখা। দুজন মিলে কী আনন্দ! আজ বেত ফল খাওয়া, কাল ভর্তা, আচার, পুতুল খেলা ইত্যাদির মাঝে সময় খুব আনন্দে কাটছিল।
এর মাঝেই একদিন টুনির বড় মামা এসে হাজির । ওর নানুর খুব অসুখ। বড় চাচি কাঁদতে কাঁদতে সেদিনই টুনিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন।
ওরা চলে গেলে ঈশিতার খুব একা লাগে । মন খারাপ করে বারান্দায় বসে থাকে। টুনিরা আসতে আসতে ওরা হয়তো চলেই যাবে, ভাবতেই ওর ভীষণ কান্না পায়।
অমনি একদিন। ” ঈশিতা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? “বলতে বলতে উঠানের কামরাঙা গাছের ডাল ছেড়ে কালো কুচকুচে একটা পাখি ঠিক ওর সামনে এসে ঝুপ করে বসে পড়ে। ঈশিতা চমকে ওঠে । ” কি হলো ভয় পেলে বুঝি? “পাখিটা হেসে জিজ্ঞেস করে। ঈশিতা তখনো অবাক হয়ে পাখিটাকে দেখছে। এটা
যে পাখির রাজা ফিঙে চিনতে ওর ভুল হয়না। তাড়াতাড়ি বলে, “নানা ভয় পাবো কেন? তোমাকে তো আমি খুব চিনি। ”
“!ওমা তাই নাকি!” “হ্যাঁ আমার গল্পের বইয়ে তোমার কথা আছে । এতদিন তোমার ছবি দেখেছি, আজ সত্যি সত্যি দেখে আমার খুব ভালো লাগছে! ”
বলতে বলতে ঈশিতা খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। ফিঙে ওর মনের কথাটা ধরতে পেরে বলে, “পাখিদের বুঝি তুমি খুব ভালোবাসো?”
” হ্যাঁ খুব ভালোবাসি। ” ঈশিতা উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয়। “ঠিক আছে, আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু হলে। ”
” সত্যি বলছো, আমাকে তোমাদের বন্ধু বানাবে! ইস কি মজা! “ঈশিতা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে৷ এবার ফিঙে ওর কান্না
রকারণ জিজ্ঞেস করে। সবশুনে বলে,” মন খারাপ করোনা ভাই, আমরা রোজ তোমার সাথে খেলতে আসব। খুশি হবে তো?” পরদিন ঠিক দুপুরে । বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। ঈশিতা পাখির পথ চেয়ে বসে আছে। একটু
পরেই একদল পাখিকে নিয়ে ফিঙে এসে হাজির। ওর কাছে এসে বলে, ” এইযে ঈশিতা, তোমার জন্য কত বন্ধু নিয়ে এসেছি দেখো । “ঈশিতা খুব খুশি হয়।
এরপর ওরা গোল
হয়ে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে । এবার শুরু হয় পরিচয়ের পালা৷ “এর নাম টুনটুনি। ও মুনিয়া। এ হলো ফুলঝুরি। ” বাহ বেশ সুন্দর নাম
তো!” ঈশিতার কথা শুনে ফুলঝুরি মুচকি হাসে । ফিঙে বলতেই থাকে, “এর নাম মথুরা। ওরা হাঁড়িচাচা, ডাহুক, মানিকজোড়, জলপিপি । আর ওই যে, ও খুব সুন্দর শিস
দিতে পারে, ওর নাম —“ফি ঙে বলার আগেই ঈশিতা বলে, “ওর নাম দোয়েল, আমি ওকে চিনি।” “কিভাবে চেনো?” সবাই চোখ বড় বড় করে তাকায়। “বাহ ওকে চিনবো না! ও যে আমাদের জাতীয় পাখি । বইয়ে ছবি আছে । ”
ও আচ্ছা! তাই বলো।”
“এই যে দেখছো দুজন, এরাও খুব সুন্দর গাইতে জানে । “ঈশিতা বলে, “তাই নাকি? ওদের কিনাম”?”এরা হলো মৌটুসী আর ফটিকজল । ” বাহ চমৎকার!”
এক কোনায় একটা নিরীহ পাখি চুপচাপ বসেছিল। ঈশিতা নাম জিজ্ঞেস করতেই আস্তে করে বলে, “আমার নাম বসন্তবৌরি। ” “কি সুন্দর সুন্দর নাম তোমাদের!”
ঈশিতা এবার একটা পাখির কাছে এগিয়ে যায়। “তুমিতো বাবুই, তাইনা? তাল, সুপারি, খেজুর গাছে বোতলের মত তোমাদের বাসা ঝুলতে দেখেছি। চমৎকার তোমাদের বাসা। তোমরা এত সুন্দর বাসা বানাতে পারো বলে মানুষ তোমাদের তাঁতি পাখি বলে এটা জানো”? ওর কথা শুনে বাবুই মিষ্টি হাসে । এরপর ওরা মজার
সব গল্প আর
খেলায় মেতে ওঠে।
এ রমাঝেই হঠাৎ করে একটা পাখি উড়ে এসে আসরে বসে । ওকে দেখে পানকৌড়ি বলে, “কিরে এত দেরি করলি কেন?” “আর বলিস না ভাই । বিলের ধারে একটু ঘুরে এলাম। ” হ্যাঁ তোর
তো আবার বিল, পুকুর, ডোবা এসব না ঘুরলে চলে না। ” পানকৌড়ি নতুন পাখির গায়ে চিমটি কেটে হাসে। “ঠিক বলেছিস, আমার তো এসব না ঘুরলে চলেনা। তোর বুঝি খুব চলে?”নতুন পাখিটা ঠোঁট টিপে হাসে । ঈশিতা অবাক চোখে পাখিটাকে দেখে। ইস, কি সুন্দর ঝলমলে পাখা! মনে হয় বুঝি রঙধনুর মেলা বসেছে। জিজ্ঞেস করে,” তোমার নামটাতো ভাই জানা হলো না?”
“নামটা আমার মাছরাঙা মাছ ধরে খাই । নদীর তীরে মাটির বাসা একদিন এসো ভাই । ”
আচ্ছা তুমি তাহলে মাছরাঙা! মামণির মুখে গল্প শুনেছি। তুমি দেখতে যেমন সুন্দর, তোমার কথাও তেমনি খুব চমৎকার। ” এতক্ষণে চুপচাপ বসে থাকা খঞ্জনি পাখিটা
কথা বলে, “ওর কথা সুন্দর হবে না? ওযে ছড়ায় কথা বলে। ঈশিতা বলে, “হ্যাঁ, তাই তো দেখছি । তুমি কোত্থেকে এভাবে কথা বলা শিখলে ভাই?” মাছরাঙা মুচকি মুচকি হাসে। অবশেষে নীলটুনি বলে,” ছড়ার দেশের রাজকুমারীর সাথে ওর ভীষণ ভাব। রাজকুমারীর কাছ থেকে
ও এত সুন্দরভাবে কথা বলা শিখেছে । ”
“বলোকি! ছড়ার দেশ?”ঈশিতার চোখে বিস্ময়ের ঢেউ । বলে, “আমার অনেক ছড়ার বই আছে। আমিও অনেক ছড়া বলতে পারি। কিন্তু ছড়ার দেশের কথাতো কোনদিন শুনিনি! কোথায় সে দেশ? কত দূর?” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে । ওর অবস্থা দেখে সব পাখি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসে ।
“সেকি! ছড়ার দেশের খবর তুমি জানোনা”? মথুরা জিজ্ঞেস করে। ঈশিতা হতাশ হয়ে বলে,” নাতো”!
মাছরাঙা আবারো ছড়ার ঢঙে জবাব দেয়, ”
ধবলগিরি ছাড়িয়ে গেলে তেপান্তরের মাঠ
মাঠপেরিয়ে রূপোয় বাধা তের নদীর ঘাট ।
তের নদীর ঘাট পেরিয়ে সাত সাগরে ঢেউ
কোন কথাযে যাচ্ছে কয়ে
কেউ জানে না কেউ।
আরো দূরে সোনার পাহাড় দেখতে আহা বেশ।
সবার শেষে লবঙ্গ দ্বীপ এটাই ছড়ার দেশ।”
ঈশিতা এবার কাতর হয়ে বলে,
তুমি আমাকে একদিন ছড়ার দেশে নিয়ে যাবে? “ওর ব্যাকুল মুখ দেখে সব পাখি ফিকফিক করে হেসে ওঠে । মধু চুষি পাখি মমতার সুরে বলে, “এত অস্থির হয়ো নাতো ভাই । মাছরাঙা আমাদের সবাইকে ওর বন্ধুর দেশে বেড়াতে নিয়ে গেছে। তুমি যখন আমাদের বন্ধু হলে তখন তুমিও যাবে বৈকি। ”
ঈশিতার মুখ
আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠে । খুশি খুশি চোখে মাছরাঙার দিকে তাকায় । মাছরাঙা হেসে বলে,” আমরা সবাই বন্ধু হলাম পরতো কোন নই
সবাই শোনো এবার আমি আসল কথা কই ।।
ওকে নিয়ে ছড়ার দেশে যাবোই যাবো ঠিক।
এবার দেখি নতুন সখি হাসতো ফিকফিক।”
মাছরাঙা ঈশিতার চিবুক ধরে নাড়া দিতে থাকে। অন্য পাখিরা এই সুন্দর দৃশ্য দেখে হাততালি দিয়ে ওঠে।
লেখিকা: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]