সিরাত থেকে দেশপ্রেম শিক্ষা | গোলাম রাজ্জাক কাসেমী

:: গোলাম রাজ্জাক কাসেমী ::
প্রকাশ: ২ মাস আগে

যে ভূমিতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, যার দোলনায় দোল খেতে খেতে সেখানকার আলো, বাতাস, রোদ, বৃষ্টি ও ছায়ায় বেড়ে ওঠে, সেটা তার মাতৃভূমি। যে ভূমির ভালোবাসা মিশে যায় রক্তের কণিকায়, হৃদয়ের গভীরে। মাতৃভূমির প্রতি এ দুর্নিবার আকর্ষণ, আবেগ ও ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। জীবনের প্রয়োজনে কখনও দূরে কোথাও গেলেও, মন পড়ে থাকে সেথায়। মাতৃভূমির কথা স্মরণ করে চোখ ছলছল করে ওঠে বারবার। শেকড়ের টানে ফিরে যেতে মন চায়। যেখানে তার পূর্বসূরিরা ঘুমায়, পরিবার-পরিজন ও প্রিয় মানুষগুলো দিবানিশি কাটায়- তা কি আর ভুলে থাকা যায়! কবি বলেন : ‘আমার দেশ আমার ওপর অবিচার করলেও তা প্রিয়, আমার পরিবার আমাকে বঞ্চিত করলেও তারা সম্মানিত।’

মাটি ও মানুষের জন্য ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতা মুসলমানের দ্বীন ও ঈমানের দাবি। ‘দ্বীন হলো কল্যাণকামিতা।’ হাদিসে বর্ণিত রাসুলের এই মূলনীতি অনুযায়ী দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসা এবং তাদের কল্যাণকামিতাও মোমিনের দ্বীন ও ঈমানেরই অংশ। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদে বলা হয়, ‘স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ ওই প্রবাদটি হাদিস না হলেও এর অর্থ সঠিক- যেমনটা বলেছেন ইমাম সাখাভী (রহ.)। (আল-মাকাসিদুল হাসানা পৃ. ২৯৭)।

রাসুল (সা.) এর সিরাতে রয়েছে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত। মাতৃভূমিকে তিনি যে অনেক ভালোবাসতেন, তা নবুয়তের সূচনাকালের একটি ঘটনায় চমৎকার ফুটে উঠেছে- হেরা গুহায় রাসুল (সা.) এর ওপর জিবরিল (আ.) সূরা আলাক্বের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাজিলের পর তিনি তা নিয়ে খাদিজা (রা.) এর কাছে কম্পিত হৃদয়ে ফিরে এলেন। এসে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ভীতি দূর হয়ে গেলে তিনি বললেন, খাদিজা! আমার কী হলো? তিনি তাকে পুরো বৃত্তান্ত শোনালেন। আর বললেন, আমি আমার জীবন সম্পর্কে শঙ্কাবোধ করছি। খাদিজা (রা.) তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, কখনও না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনও লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা, আপনি তো আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখেন। সত্য কথা বলেন, অনাথ-অক্ষমদের বোঝা বহন করেন। মেহমানদের মেহমানদারি করেন এবং হকের পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সহায়তা করেন।
তারপর মা খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.) কে ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাতিজা! তুমি কী দেখ?’ আল্লাহর রাসুল (সা.) যা দেখেছিলেন, সবই বর্ণনা করলেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ‘এটা সেই বার্তাবাহক, যাকে আল্লাহ মুসা (আ.) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন হতবাক হয়ে বললেন, ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ অনুরূপ (অহি) কিছু যিনিই নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে।’ (বোখারি : ৩)।
রাসুলের কাছে জন্মভূমি এত প্রিয় ছিল যে, তাকে ছেড়ে যাওয়াকে অসম্ভব মনে হয়েছিল। তাই তিনি ব্যথিত হয়ে বিস্ময় জড়ানো কণ্ঠে বলেছেন, ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে?’ মাতৃভূমির প্রতি রাসুলের যে সীমাহীন ভালোবাসা ছিল, তা এই বিস্ময়মাখা প্রশ্নের ভেতরই লুকিয়ে আছে।

বিদায় বেলায় নবীজির বিচ্ছেদবেদনা
হিজরতের রাত। মক্কা নগরী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। প্রাণের মাতৃভূমিকে ছেড়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছেন নবীজি (সা.)। সেদিন নবীজির মনে ভীষণ কষ্ট! বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন। স্মৃতির শহরটাকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন। যে শহরে কেটেছে অসংখ্য নির্ঘুম রাত। কেটেছে জীবনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকাল। প্রিয় শহরটাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবেননি কোনোদিন। মক্কার উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে প্রিয় শহরটাকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিলেন। মক্কার বাড়িঘর, পাহাড় ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর দিকে তাকিয়ে রাসুলের চোখে পানি চলে আসে! বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তাঁর। দুচোখ বেয়ে টপটপ ঝরছিল অশ্রু। বিদায়ের সেই আবেগঘন মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) সজল দৃষ্টিতে মাতৃভূমির দিকে তাকিয়ে বারবার বেদনায় বিদগ্ধ হয়েছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে কাতরকণ্ঠে মক্কাকে উদ্দেশ করে বলেছেন : ‘মক্কা, কতই না পবিত্র ও উত্তম শহর তুমি। কতই না প্রিয় তুমি আমার। বিশ্বাস করো, ওরা যদি আমাকে তোমার বুক থেকে বের করে না দিত তাহলে কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (তিরমিজি : ৩৯২৬)।
মাতৃভূমি ত্যাগের ‘যন্ত্রণা’ বরদাশত করতে চায় না মন। তার বিরহবেদনার ক্ষত সারে না আমরণ! তাই তো আল্লাহ তায়ালা মাতৃভূমির বিচ্ছেদ ও প্রাণ হত্যার বিষয়দ্বয়কে একসঙ্গে উল্লেখ করে বলেন : ‘আমি যদি তাদের ওপর ফরজ করে দিতাম যে, তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা কর অথবা নিজেদের নগরী থেকে বের হয়ে যাও, তবে তারা তা করত না- তাদের অল্পসংখ্যক লোক ছাড়া। তাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, তারা যদি তা পালন করত, তবে তাদের পক্ষে তা বড়ই কল্যাণকর হতো এবং তা (তাদের অন্তরে) অবিচলতা সৃষ্টিতে অত্যন্ত সহায়ক হতো।’ (সূরা নিসা : ৬৬)।

ধর্মের ক্ষতি করে দেশপ্রেম নয়
মাতৃভূমির প্রতি রাসুল (সা.) এর সীমাহীন ভালোবাসার ফলেই তা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না। নবুয়ত লাভের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদীর্ঘ ১৩ বছর স্বদেশ মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে শত নির্যাতিত ও কষ্ট সহ্য করেছেন। আশায় ছিলেন একদিন স্বজাতির বিবেক জাগ্রত হবে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু তারা রাসুলের দাওয়াত কবুল করল না বরং মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। এভাবে নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে দ্বীনকে টিকিয়ে রাখতে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কেননা ধর্মের গুরুত্ব ও মর্যাদা মাতৃভূমি, পরিবার ও পরিজন থেকেও বেশি।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন : ‘যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা তওবা : ৪০)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে : ‘নিজ সত্তার ওপর জুলুমরত অবস্থায়ই ফেরেশতারা যাদের রুহ কব্জা করার জন্য আসে (তাদের লক্ষ্য করে) তারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, ভূখ-ে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ পরিণতি।’ (সূরা নিসা : ৯৭)।

মাতৃভূমির প্রতি দেশের জনগণের যে আবেগ-ভালোবাসা, তা রাসুলের আদর্শের অনুগত হতে হবে, তাহলেই আসবে দেশের প্রকৃত কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। পক্ষান্তরে এই আবেগ ও ভালোবাসার নামে যদি পাপ ও অশ্লীলতা বেড়ে যায়, তাহলে দেশ ও জাতির জন্য আমরা নিজেরাই হবো সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক।

 

লেখক: গোলাম রাজ্জাক কাসেমী, বিভাগীয় প্রধান, (আরবি ভাষা বিভাগ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, গুলশান, ঢাকা।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]