গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডেনে নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশকে বিশেষ ঘনিষ্ঠ অংশীদার মনে করে দেখেই এমন কাজ করে ভারত সরকার। এটি দুই দেশের মধ্যকার উষ্ণ সম্পর্কের একটি নিদর্শনও বটে।
তবে এক বছর পর এখন শেখ হাসিনার এই দহরম-মহরম সম্পর্কই ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি আগস্ট মাসের শুরুর দিকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। তিনি পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।
সপ্তাহ তিনেক পার হয়েছে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত। তারপরও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব এখনো তুঙ্গে। হাসিনাকে ফেরত দেয়ার দাবি থেকে শুরু করে পানি ও ভিসাকে প্রতিবেশী এই দেশের বিরুদ্ধে ভারত ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ। বুধবার (২৮ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া তিক্ততার কারণগুলো সামনে নিয়ে এসেছে আলজাজিরা।
হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি বিরোধীদের
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর সামরিক বিমানে করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান হাসিনা। সেদিন তিনি নয়াদিল্লির কাছাকাছি একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। সেখানে তাকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল স্বাগত জানান। তখন থেকে তিনি ভারতের রাজধানী ও এর আশপাশে বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে দিন যত সামনে গড়াচ্ছে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি বাড়ছে। সোমবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, হাসিনাকে বাংলাদেশেই হস্তান্তর ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই দিনে একই ধরনের দাবি করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। গত ৬ আগস্ট বিলুপ্ত বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘ভারতের উচিত হাসিনার কাছ থেকে জবাবদিহি আদায়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করা। কারণ তিনি স্পষ্টতই বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি করেছেন।’ এরই মধ্যে হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা হয়েছে।
গত সপ্তাহে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার কূটনৈতিক ভিসা বাতিল করেছে। এই ভিসা ছাড়া হাসিনা কতদিন বৈধভাবে ভারতে থাকতে পারবেন তা স্পষ্ট নয়। ভারত সরকার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজ বলেন, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে প্রত্যর্পণ দাবি করছেন সাধারণ মানুষ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ছয় শতাধিক মানুষকে গুম করেছে। এমনকি হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
ভয়াবহ বন্যা
চলতি আগস্ট মাসে বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বের প্রদেশ ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২৩ আগস্ট বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার মানুষকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১১টি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় দেশের বাকি অংশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ভয়াবহ এই বন্যা দেখা দেয়ার পরপরই বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে ভারত ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীর উজানে অবস্থিত ডুম্বুর বাঁধ ইচ্ছাকৃতভাবে খোলার কারণে এই বন্যা হয়েছে। গোমতী নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে।
তবে ২২ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, অত্যধিক বৃষ্টি ও বাঁধের নিচের দিকের এলাকার পানির কারণে এই বন্যা হয়েছে।
ভারতীয় বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও কারিগরি আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ এবং নদী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগ সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জানান, অনেক বেশি উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বাঁধ থেকে পানি ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে’।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা অবশ্য আলজাজিরাকে বলেছেন, অতীতের মতো এবার পানি ছাড়ার বিষয়ে কোনো সতর্কতা জারি করেনি ভারত। সতর্ক করা হলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করা যেত।
আলী রিয়াজ বলেন, বন্যার কারণ যাই হোক না কেন, অনেক বাংলাদেশি পানি বণ্টনের অতীত অভিজ্ঞতার কারণে ভারতকে দোষারোপ করেছেন। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের অভিন্ন নদী থেকে আরও বেশি পানি দাবি করে আসছে। এ ধরনের একটি চুক্তির এক দশকের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থায় রয়েছে। বিষয়টি ঢাকার জন্য বেদনাদায়ক।
তিনি বলেন, বর্ষাকালে আমরা দেখেছি বাংলাদেশ পানিতে ডুবে থাকে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানি চাইলেও পায় না।
বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোতে কী হচ্ছে?
মঙ্গলবার ঢাকা ও সাতক্ষীরায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসিএস) বন্ধ ছিল। কয়েক’শ মানুষ ভিসা প্রক্রিয়াকরণে বিলম্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একদিন পর এটি করা হয়। হাসিনার পতনের পর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে ঢাকায় নিজেদের কূটনৈতিক উপস্থিতি কমিয়ে আনে নয়াদিল্লি।
২০২৩ সালে প্রায় ১৬ লাখ বাংলাদেশি ভারতে গিয়েছিলেন। পর্যটন ও চিকিৎসার কারণে ভারতে বেশি ভ্রমণ করেন বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক কেন অস্থির?
নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে সাম্প্রতিক দশকে হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে ভারত নিজেদের স্বার্থের জন্য বেশি উপযোগী বলে মনে করেছে। হাসিনার অনেক সমালোচক বলছেন, ভিন্নমত দমন, বিরোধীদের গ্রেপ্তার ও নির্বাচনে কারচুপির মতো বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়েছে ভারত।
আলী রিয়াজ বলেন, বিভিন্ন ন্যায্য ইস্যুতে অসন্তোষের জেরে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। হাসিনার প্রতি ভারতের অন্যায় সমর্থন ছিল। এর অর্থ হলো দেশে তিনটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন ও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনকে সমর্থন দিয়ে এসেছে ভারত।
এখানে তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের উদাহরণ তুলে ধরেন। জানান, জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন বর্জন থেকে বিরত রাখতেই তিনি এই সফর করেন।
আলী রিয়াজের ভাষায়, এটি আওয়ামী লীগকে একটি লাইফলাইন দেয়। কারণ ওই নির্বাচন বেশিরভাগ বিরোধী দল বর্জন করে। এর পরপরই খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে আন্তর্জাতিকভাবেও সতর্কতা জারি করেন মোদি। তবে এর আগে ১৬ আগস্ট ড. ইউনূস মোদিকে ফোন করে দেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বাস দেন।
আলী রিয়াজ বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত করা এখন সব দিক থেকে ভারতের দায়িত্ব। কারণ হাসিনার শাসন ভারতের সমর্থনের কারণে টিকে ছিল।
হাসিনার দীর্ঘ সময়ের শাসনের অবসানের কথা উল্লেখ করে রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। ভারতীয়দের উচিত আজে বাজে না বকে তাদের নীতি পুনরায় ঠিক-ঠাক করা। বাংলাদেশ যে সামনে এগিয়ে গেয়ে তা মেনে নেয়া।