এক মাসজুড়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে দফায় দফায় কারফিউ দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময় শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন শিল্পমালিকরা। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে ব্যাংক ঋণের কারণে।
শিল্পমালিকরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হতে সময় লাগবে। কিন্তু ঋণের কিস্তি তো বসে নেই। মাস শেষ হলেই কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত আয় করে কিস্তি পরিশোধ করা হয়। যেহেতু এখন কাক্সিক্ষত আয় নেই, তাই বিপাকে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি, আপাতত ৬ মাস মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রাখা উচিত। তা না হলে উদ্যোক্তারা ঋণখেলাপি হয়ে যাবেন। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আমরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের পক্ষে নই। তবে অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অর্থনীতিতে পুনর্বাসনে নীতি সহায়তা করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনারও অনুরোধ জানান তারা।’
এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে ২০ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে লিখিত একটি সুপারিশ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)। এতে উলেখ করা হয়, চলমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন, সাপ্লাই চেইন, লজিস্টিক ও আমদানি-রপ্তানি সবকিছু এক রকম বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ফলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হয়েছে।
যার বিরূপ প্রভাব এখনো কাটেনি। বিক্রি এবং কালেকশন সবকিছুতে ধস নেমেছে। এতে করে কোনো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা শিল্পকারখানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে শিল্পের উপকরণ বা কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ব্যাপক দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে জ্বালানি খরচ ও পরিবহণ ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে। ফলে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেও শিল্প ও রপ্তানি খাতকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এছাড়া কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩ মাসের স্থলে ৬ মাস করার প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই। বর্তমানে ঋণের অপরিশোধিত কিস্তি যে তারিখে পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকবে সে তারিখ থেকে পরবর্তী ৩ মাস পর মেয়াদোত্তীর্ণ হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ থেকে ৬ মাস পর যেন মেয়াদোত্তীর্ণ দেখানো হয়। এর আগেও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৬ মাস ছিল। সে মেয়াদ আবার ফিরিয়ে আনার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প রক্ষার স্বার্থেই এই দাবি করেন তারা। এছাড়া উৎপাদনকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণকে দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তরের প্রস্তাব করেন ব্যবসায়ীরা।
ডলার সংকটে ডলারের বিনিময়জনিত ক্ষতির অঙ্ক ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের নিয়মিত হিসাবের বাইরে একটি হিসাব খুলে ২ বছরের গ্রেস পিরিয়িডসহ ১৫ বছরের ইক্যুয়েটেড মান্থলি ইনস্টলমেন্ট (ইএমআই) ভিত্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ দিতে হবে। সুষ্ঠু আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) জোগান স্বাভাবিক রাখতে হবে।
শিল্প উৎপাদন টেকসই করতে বিনিয়োগ বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নীতি সহায়তা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফশিল ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা নতুন গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছি। ৩ মাস পর যে খেলাপি হবে, সেটা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে। আবার মার্চ থেকে নির্ধারিত তারিখে এক মাস পর খেলাপি কার্যকর হবে। গভর্নরকে বলেছি আপাতত এসব বন্ধ করতে। আগের নিয়মে নির্ধারিত তারিখ থেকে ৬ মাস পর খেলাপি করা হোক। এছাড়া স্বল্প সুদে শ্রমিকদের এক মাসের বেতনের টাকা চেয়েছি। যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।
গভর্নর বলেছেন, এ খাতে অনেক লুটপাট হয়েছে। এর জবাবে আমরা বলেছি, কোনো লুটপাটকারীর সঙ্গে আমরা নেই। তাদের বিচার করুন। শক্তহাতে দমন করুন।
বিজিএমইএ প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ১৫ জুলাই থেকে বায়াররা অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। এতে ১৫-২০ দিন পিছিয়ে গেছি। ফলে তারল্য সংকটে পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ৬ মাস ব্যাংক ঋণ পরিশোধ বন্ধ রাখতে হবে। কর্মচারীদের দুই মাসের বেতন স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে দিতে হবে। সে ঋণ দুই বছরে পরিশোধ করে দেব। এছাড়া নিরপরাধ কোনো ব্যবসায়ী যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।