পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়া ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেনি ২ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ জন। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এক লাখেরও বেশি।
এ বছর ২ হাজার ৯৭৫টি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে, তবে ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি। গত বছর এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৮। ২০২১ সালে শতভাগ পাসের প্রতিষ্ঠান ছিল ৫ হাজার ৪৯৪।
প্রশ্ন উঠেছে, আগের বছরের তুলনায় এবার পাসের হারে কেন এত অবনতি? এটি ধারাবাহিক ঘটনা কি না, কী এর কারণ- তেমন প্রশ্নও উঠছে।
তবে কয়েকটি বছরের ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের পরিসংখ্যান বাদ দিলে এর আগের বছরগুলোর তুলনায় পাসের হারে এবার বড় ধরনের হেরফের নেই। বরং ২০১৯ বা ২০২০ সালের তুলনায় এবার পাসের হার খানিকটা বেশি।
চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সামগ্রিকভাবে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ এ বছর ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
আগের বছর ২০২১ সালে মাত্র ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেনি।
তবে ২০২০ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অর্থাৎ সে বছর ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
তারও আগের বছর ২০১৯ সালে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। চারটি বছরের ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত বছরটিতেই কেবল আকস্মিকভাবে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে আসে।
২০২১ সালে বিশেষ উন্নতির পেছনে কী কারণ ছিল?
শিক্ষা বোর্ড এবং বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা বলছেন, করোনাকালীন বিশেষ পরিস্থিতি ২০২১ সালের পরীক্ষায় বিস্ময়কর পাসের হারে ভূমিকা রেখেছে। করোনা মহামারির অচলাবস্থার পর গত বছরের এসএসসিতে মাত্র তিনটি পরীক্ষা নেয়া হয়।
গত বছর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা/উচ্চতর গণিত বিষয়ে তিনটি পরীক্ষা হয়। মানবিকে ছিল ভূগোল ও পরিবেশ, বাংলাদেশের ইতিহাত ও বিশ্বসভ্যতা, পৌরনীতি ও নাগরিকতা/অর্থনীতির ওপর তিনটি পরীক্ষা। আর ব্যবসায়ে শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগ বিষয়ে পরীক্ষা দেয়।
অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে নম্বর যোগ হয় জেএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। ফলে অনেক চাপমুক্ত থেকে পরীক্ষা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। অকৃতকার্যের হারও ছিল অনেক কম। বিপরীতে এ বছর নয়টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
পরীক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল কেমন হলো তা সঠিক পর্যালোচনা করতে তুলনাটি করতে হবে করোনা স্থবিরতা তৈরি হওয়ার আগের বছরগুলোর সঙ্গে। আর সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২০ সাল বা ২০১৯ সালের তুলনায় পাসের হার এবার বেড়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, ‘আমাদের এবারের ফলের সঙ্গে ২০২১ সালের তুলনা করা উচিত হবে না। তুলনা করতে হলে ২০১৯ বা ২০২০ সালের সঙ্গে করা উচিত।
‘২০২১ সালে শিক্ষার্থীরা সুবিধা পেয়েছে বেশি। অর্ধেক নম্বরের ওপর পরীক্ষা ছিল। এবার কিন্তু তা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘২০১৯ অথবা ২০২০ সালে পরীক্ষার্থীদের জন্য কোনো আলাদা সুযোগ ছিল না। করোনা পূর্ববর্তী সময়ের হওয়াতে সবগুলো বিষয়ের ওপর ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছিল।’
যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, ‘গতবার কম বিষয়ের কারণে পাসের হারও বেশি ছিল। শর্ট সিলেবাসে তারা বেশি সুযোগ পেয়েছে। এবার সিলেবাসও কম ছিল আবার পরীক্ষায় অপশন বেশি ছিল। তবে এবার যারা পাস করেছে তারা সবাই ভালো করেছে।’
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান বেগম বলেন, ‘যদি আমরা ফলাফল ও শিখনের ওপর গুরুত্ব দিই তবে আমাদের এবারের ফল ২০২০ সালের চেয়ে ভালো। ২০২১ সালে মাত্র তিনটি বিষয়ে অর্ধেক নম্বরের ওপর পরীক্ষা হলেও এবার নম্বর ও বিষয় বেড়েছে।’
বরিশাল জিলা স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ সাহা অবশ্য মনে করছেন এবারের ফলের ওপরেও করনাকালীন পরিস্থিতির প্রভাব রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘করোনার একটা প্রভাব থেকেই যাবে। যত সুযোগ দেয়া হোক না কেন একটা শিখন ঘাটতি থাকবে। অনেকেই সে সময় ঝরে গেছে, যারা ছিল তারাই ভালো করেছে। এটা ঠিক হতে কিছু বছর সময় লাগবে।’
প্রভাব ফেলেছে বন্যাও
এসএসসি পরীক্ষার সময়ে সিলেট বিভাগে বন্যা ওই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এবার সিলেট বোর্ডে সবচেয়ে কম ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সোমবার ফলের বিস্তারিত তুলে ধরার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও এ বিষয়টি তোলেন।
পরীক্ষায় পাসের হার নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই সব শিক্ষার্থী পাস করবে। আমাদের সবকিছুই ঠিক ছিল, তবে একটা কারণে (বন্যা) সেটা হয়নি। সবকিছু বাদ দিয়েছি। নতুন করে আবার রুটিন দিয়েছি। এ কারণে কিন্তু শিক্ষার্থীর ওপর একটা চাপ পড়ে। একরকম প্রিপারেশন থাকে, সেটা ব্যাহত হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বোর্ডের রেজাল্ট কিন্তু একটা আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলে। যশোর বোর্ডে যেমন ৯৫ ভাগ আছে, আবার কোথাও কোথাও ৭৮ ভাগ। বন্যার কারণে এটা হতেই পারে। অনেক স্কুলে সমস্যা হয়েছে, অনেক পরীক্ষার্থীকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়েছে।’
কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পাসের হার নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকবার এটা নিয়ে যে ব্যবস্থা নিই, এবারও সেটা নেব। আমরা কতটা সাপোর্ট দিয়ে থাকি আর কোথায় ঘাটতি আছে সেটা দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা লার্নিং গ্যাপ আছে। এটা সারা বিশ্বেই আছে। তবে এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের লার্নিং গ্যাপ করোনার সময় বাড়েনি। অনেক দেশে এটা অনেক বেড়েছে। এখানে সে সময় ৯৩ ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে অ্যাসাইনমেন্টপদ্ধতি পৌঁছে গিয়েছিল, এতে তারা নিজেরাই শিখন ঘাটতি পূরণ করেছে।’
গত বছরের চেয়ে এবার বেড়েছে জিপিএ ফাইভ
গত বছরের চেয়ে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার কমলেও জিপিএ ফাইভ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ। চলতি বছর জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ শিক্ষার্থী।
এবার সাধারণ বোর্ডে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ শিক্ষার্থী। পাসের হার ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ।
দাখিলে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৭ শিক্ষার্থী। পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ।
কারিগরি বোর্ডে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৫ শিক্ষার্থী। পাসের হার ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।