রনজিতের মন মেজাজ আজ অনেক ভালো। করোনা মহামারীর কারণে গত দু’বছর ধরে বাজারের সব দোকানের বেচাকেনায় মন্দা। গত কয়েক দিন ধরে ভালোই মালপত্র বিক্রি হচ্ছে। আজ যেভাবে ক্রেতার সমাগম, এরকম মাসে সাত-আট দিন হলে দু’বছরের লোকসান পুষিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না।
গত লকডাউনে কোত্থেকে এক পাগলী বাজারে হাজির। অল্প বয়স। মাথাভর্তি চুল। উসকো-খুসকো চুলে কেমন যেন মাদকতা। মেঠো চেহারার সুঠাম দেহের সৌন্দর্য অনেককে মুগ্ধ করে। ময়লা পোশাকে দুর্গন্ধ ছড়ায় বলে কেউ কাছে ভিড়ে না। কামুক পুরুষগুলো দূর থেকে হা-হুতাশ করে। অনেকে ভোগের নেশায় লোকচক্ষুর আড়ালে পিছে পিছে ঘোরে কিন্তু বাগে পায় না। নাম না জানা পাগলীকে কমবেশি সবাই খেতে দেয়। এর মধ্যে কারো কারো উদ্দেশ্য থাকে ভিন্ন কিন্তু সুযোগের অভাবে তাদের হীন আশা দূরাশাই থেকে যায়।
পাগলীর চাহনিতে একধরনের ঘৃণা লক্ষ্য করা যায়। এ ভঙ্গুর সমাজের প্রতি তার যে আস্থাহীনতা তা কেউ বুঝতে চায় না। চা দোকানে বা রেস্টুরেন্টে বসা সমাজের অনেক উঁচুদরের মানুষও আড়ালে আবডালে পাগলীর সাথে খুনসুটি করে। অনেক সময় তার শরীরের স্পর্শকাতর যায়গায় খোঁচা দিয়ে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পাগলী তা বুঝে। তার অঙ্গভঙ্গিতে প্রকাশ পায় এরা কেউ মানুষ না। এরা কুত্তার চেয়েও খারাপ। মানুষের আদলে গড়া অমানুষ।
ইদানিং পাগলী রনজিতের দোকানের দক্ষিণ পাশের ছোট কদম ফুল গাছের নিচে আস্তানা গেড়েছে। সারাদিন বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ায়। আর সূর্য ডোবার কিছু পরে কদম গাছটার নিচে এসে বসে। বাজারের লোকসমাগম কমে গেলে ঘুমোতে যায়।
রনজিতের সাথে পাগলীর ভাব জমেছে ভলোই। অন্য কেউ ধারে কাছে আসলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু রনজিতকে সে বিশেষ সমাদর করে। তার দোকানের আশপাশে সন্ধার পরে ঘোরাঘুরি করে। রনজিত এটা-ওটা খেতে দেয়। প্রায়ই দুপুরের খাবারের অবশিষ্টাংশ পাগলীকে খেতে দেয়। এটা ধীরে ধীরে নিয়মে পরিনত হয়। দুপুরে খাবার সময় হলেই পাগলী রনজিতের দোকানের সামনে এসে হাজির হয়। রনজিতও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দুজনের মধ্যে একটা অজানা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
দুই
আজকাল রনজিত পাগলীর প্রতি আগের চেয়ে বেশি সহনশীল। একটু পরপর তাকে না দেখলে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করে। পাগলীও কেমন যেন রনজিতের প্রতি একধরনের টান অনুভব করে। কোনো কোনো দিন দোকানে আসতে দেরী হলে, যে পথে রনজিত বাজারে আসে সে পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে যায়। দূর থেকে রনজিতকে আসতে দেখে তার দিকে ছুটে যায়। নানান অঙ্গভঙ্গিতে আহলাদ প্রকাশ করে। অনেক সময় বেচাকেনায় চাপ বাড়লে বিশেষ করে হাটের দিনে রনজিত রাতের মাঝ অবধি পর্যন্ত দোকানে থাকে। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাতে যখন সে টর্চ লাইটটা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়, পাগলী তার পিছু নেয়। রনজিত অবশ্য মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয় কিন্তু যখন বুঝতে পারে অন্ধকার রাতে সে তারে পাহারা বা সঙ্গ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাথে যাচ্ছে তখন রনজিতের ভালোই লাগে। তার বাড়ির কিনারা পর্যন্ত এসে ইশারা করে বোঝায় সে এখন দুশ্চিন্তা মুক্ত। রনজিত চলে যেতে বললে, একগাল হাসি দিয়ে বিদায় নেয়।
তিন
পাগলীর সাথে রনজিতের এই সখ্যতা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। অনেকে কানাঘুঁষা করে। কিন্তু রনজিত কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। পাশের দোকানের আজগর মাঝে মধ্যে বলে, পাগলীর সাথে তুইও পাগলামি শুরু করলি নাকি?
রনজিত হাসে। বলে, একজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে কি পাগলামি হয় রে!
– সমাজে সবসময় সব কাজ করা যায়না রনো।
– তা জানি। তাই বলে মানুষকে সেবা করা বন্ধ থাকবে?
আজগর রনজিতের সাথে কথায় পেরে ওঠে না। তাই কথা না বাড়িয়ে কাজে মন দেয়।
দুপুরের সময় যথারীতি পাগলী খেতে আসে। রনজিত এক টুকরা ইলিশ মাছ আর একটু সবজি দিয়ে এক প্লেট ভাত দেয়। ক্ষুধার্ত পাগলী কয়েক মিনিটের মধ্যে খেয়ে সাবাড় করে। রনজিত বুঝতে পারে আজ পাগলীর খুব খিদে ছিল। থালাটা চেটে পুঁটে খেয়ে পাশের মসজিদের টিউবওয়েলের পানি দিয়ে থালাটা ভালো করে ধুয়ে আনে। পাগলীর এই সামাজিকতা দেখে রনজিত অবাক হয়। মনে মনে ভাবে, আসলে যতটা তাকে পাগল মনে করে মানুষ ততটা সে পাগল নয়। থালাটা নিয়ে রনজিত তাকে জিজ্ঞেস করে, এই শোন।
রনজিতের কথা শুনে পাগলী থমকে দাঁড়ায়। তার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকায়। রনজিত তা লক্ষ্য করে। বলে, তোর সাথে অনেক দিন চললাম কিন্তু তোর নামটা জানা হলো না।
পাগলী হাসে। এদিক-সেদিক তাকায়। কোন জবাব দেয় না। তখন রনজিত বলে, তোর নাম বলবি না।
পাগলী তখনও কিছু বলে না। উসকো-খুসকো চুলে আঙুল দিয়ে চুলকাতে থাকে। রনজিতের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে একটু উচ্চ স্বরে বলে, এই তোর নাম জানতে চাইলাম না? বলিস না কেন? তোরে কি নামে ডাকব?
পাগলী একটু অবাক হয়। রনজিতকে রাগান্বিত দেখে কিছুটা বিব্রত হয়। রনজিত তা বুঝতে পারে না। পাগলীকে চুপচাপ দেখে তার অনেক রাগ হয়। তাই ধমক দিয়ে বলে, তোর কোন নাম নেই। নিজের লাভটা বুঝিসতো ভালো। খাওয়ার সময় হলে ঠিকই চলে আসিস। যা এখান থেকে।
রনজিতের ধমক পাগলীকে কিছুটা কাপিয়ে দেয়। বাজারের কতজন কত ধমক, নোংরা কথা পাগলীকে বলে তাতে পাগলীর কোন দিন মন খারাপ হয়নি। কিন্তু আজকে রনজিতের এরকম কর্কশ ও শক্ত কথা তাকে বিচলিত করে তোলে। কিছু একটা প্রকাশ করতে চেয়েও পারে না। শুধু মনে মনে বলে, তোমরা আমাকে যতটা অস্বাভাবিক মনে করো আমি তা নই।
রনজিতের ধমকের পর পাগলীর চোখের কোনায় কষ্টের নোনা জল চিকচিক করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাতের নোংরা পোটলাটা কদম গাছের নিচে ছুঁড়ে মারে। তারপর হনহন করে বাজারের উত্তর পাশের নদীটার কোল ঘেঁষে অনেক দূর চলে যায়।
চার
পাগলীকে কড়া কথা বলার পর থেকে রনজিতের মন খারাপ থাকে। বেচাকেনায় এত ব্যস্ত ছিল যে, তার খোঁজখবর নিতে পারেনি। মাঝে মধ্যে যখন খদ্দের থাকে না, তখন এদিক সেদিক লক্ষ্য করে কিন্তু কোথাও পাগলীকে দেখা যায় না। কাজের চাপে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে মাঝ রাত গড়িয়েছে, রনজিত বুঝতে পারেনি। ঘড়ির দিকে নজর পড়ে। রাত একটা ছুঁইছুঁই। রনজিত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘরে ফেরার জন্য। কিন্তু হঠাৎ দমকা বাতাসের সাথে নামে অঝোরে বৃষ্টি। দোকানে বসে আকাশের ভাবগতি বোঝা যায় না বিশেষ করে রাতে। কালবৈশাখী ঝড় আর বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোটায় মনে হচ্ছে রাস্তা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আশপাশের অনেক দোকান মালিক দোকান বন্ধ করে আগেই চলে গেছে। রনজিত দৈনিক হিসাবের খাতা ঠিকঠাক করতে দেরি করে ফেলে। মূষল বৃষ্টিতে বের হলে কাক ভেজা ছাড়া উপায় নেই। অগত্যা উপায় না দেখে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকে। হঠাৎ দক্ষিণ পাশের কদম গাছটার নিচে কার যেন উপস্থিতি টের পায়। দোকান থেকে ঝুকে মাথাটা বের করে দেখে পাগলী। বজ্রপাতের আচমকা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পায় রনজিত। দোকান থেকে বের হয়। ছাতা খুলে মাথায় দিয়ে কদম গাছের নিচে পাগলীর কাছে যায়। কাকভেজা পাগলী শীতের প্রোকোপে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। রনজিত বলে, এভাবে ভিজতেছিস কেন? দোকানে চল।
জেদি পাগলী আপোষহীন মূর্তির মতো সটান হয়ে বসে থাকে। রনজিত বারবার বলে কিন্তু কোন উত্তর দেয় না। একপর্যায়ে রনজিত বিরক্ত হয়। জোর করে দোকানে নিয়ে আসে। ঠান্ডায় কাতর পাগলী কাঁপতে থাকে।
বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়া ময়লার পরে পাগলীর আসল গায়ের রং ফুটে ওঠে। মেঠো রং সব বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়। কাঁচা হলুদের মতো স্বর্ণালী রঙে পাগলীকে আলাদা জগতের মানুষ মনে হয়। দোকানের আলোতে আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রনজিতের চোখে ধাঁধা লাগে। বিদ্যুতের মত আলোর বিচ্ছুরণ তার চোখে মুখে খেলে যায়। পাগলী ভেজা কাপড় আনমনে সরাতে থাকে। দোকানে কোন শুকনো কাপড় নেই বলে রনজিত পুরনো একটা বেডশিট পাগলীকে দেয়। বলে, ওপাশে গিয়ে এইটা আপাতত পর।
পাগলী কিছু না বুঝে রনজিতের সামনে কাপড় খুলতে থাকে। রনজিত নিষেধ করলেও পাগলী শোনে না। ঠান্ডায় কাতর পাগলী কাপড় ছেড়ে বেডশিট পরতে থাকে। পাগলীর উন্মুক্ত বক্ষ দেখে রনজিত দিশেহারা হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়েমুছে ছাপ হয়ে যাওয়া পাগলীর শরীর তার দেহে মনে ঝড় তুলে দেয়। সে অস্থির হয়ে ওঠে। ময়লা আবর্জনার খোলস থেকে বের হয়ে আসা পাগলীকে পরীর মতো সুন্দরী দেখায়। রনজিত স্থির থাকতে পারে না। কাপড় পেচিয়ে দেবার অজুহাতে পাগলীর কাছে যায়। কাপড় পেচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে তার হাত দু’একবার পাগলীর স্তনে স্পর্শ করে। পাগলী কিছু বলে না। নানান ছলে রনজিত পাগলীর শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর যায়গায় হাত দেয়। কিন্তু পাগলী তখনও চুপচাপ থাকে। রনজিত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। পাগলীর গ্রীবা, উন্মুক্ত বক্ষ, পিঠ নানান যায়গায় লেহন করে। একসময় দেখে পাগলী চোখ বন্ধ করেছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। উত্তেজিত রনজিত কালক্ষেপণ করে না। দ্রুত দোকানের দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাতে রনজিত আর বাসায় ফেরেনি। খুব ভোরে অত্যন্ত সচেতনভাবে পাগলীকে দোকান থেকে বের করে দেয়।
পাঁচ
ঐ দিনের পর থেকে পাগলী রনজিতকে বিশেষ সমীহ করে। তার আচার-আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রনজিত যখনই তাকে ইশারা ঈঙ্গিত করে সে চলে আসে। রাতে রনজিত দোকান বন্ধ করে চলে আসার পর পাহারাদারের মত দোকান পাহারা দেয়। দোকানের বাহিরে দোকান সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, নিজের সম্পদের মতো আগলে রাখে। প্রতিদিন ভোরবেলা দোকানের সামনে ফাঁকা জায়গা সে ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করে রাখে। রনজিত এসব কাজে মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু আবার সঙ্কিতও হয় এই ভেবে যে, মানুষ নানান কথা রটাবে। তাই পাগলীকে নানানভাবে বুঝিয়ে বলে এসব না করতে। কিন্তু পাগলী তা শোনে না।
রনজিত পরে বুঝতে পারে পাগলী আসলে কথা বলতে পারে না, কিন্তু কানে শুনতে পায়। কারণ রনজিত কিছু করতে বললে সে তা করে। কিন্তু কথা বলে না। কতবার তার নাম জিজ্ঞেস করেছে, সে তার নাম বলেনি।
পাগলী এখন একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। তাতে তার রুপ লাবন্য আগের চেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বিশেষ করে তার উন্নত বক্ষ বাজারের কামুক পুরুষগুলোকে আকৃষ্ট করে। সন্ধ্যার পরে অলিগলিতে যখন আলো স্বল্পতা থাকে প্রায় প্রতিদিন দু’চারটি পুরুষ তার গাঘেঁষার চেষ্টা করে। কিন্তু পাগলী তখন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। লাঠি বা ইটের টুকরা দিয়ে আঘাত করে। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু কিছু নরপশু রাতের আধারে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ সুবিধা করতে পারে না। বরং দু’চারটা ইটের ঘা বা লাঠির বাড়ি খেয়ে তারা ফিরে যায়।
কিছু দিন আগে মান্নান দোকানদার পাগলীকে ফুসলিয়ে ভোগ করবার চেষ্টা করে। পাগলীর চিৎকারে মান্নান দোকানদারের আশা দূরাশা থেকে যায়। শুধু তাই না, রনজিতের অভিযোগে সন্ধ্যার পরে বাজারের সমিতি ঘরে শালিস বসে। বাজার কমিটির সদস্যবর্গ ও বাজার মসজিদের ইমাম সাহেব শালিসিতে উপস্থিত ছিলেন। নানান জনের নানান কথা শুরু হয়। রনজিত একজন অসহায় পাগলীর সম্ভ্রমের সম্মান রক্ষার বিচার চাইতে গিয়ে একরকম বিপদেই পড়ে। শেষমেষ পাগলীকে বাজার থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চলতে থাকে। তখন রনজিত ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, পাগলীর কি দোষ। মান্নান চাচাইতো তারে ইয়ে করতে….
ইমাম সাহেব বললেন, বুঝলাম তো। একজন বেগানা পর্দাবিহীন মেয়ে মানুষ রাতবিরাত বাজার ঘাটে ঘুরাফেরা করলে এসবতো হবেই। তার চেয়ে ভালো তাকে বাজার থেকে বের করে দেওয়া।
বাজার কমিটির সভাপতি বলেন, ইমাম সাহেব যে কথাটা বলেছেন তা মন্দ না।
এপাশ ওপাশ থেকে দু’একজন হ হ বলে সমর্থন করে। রনজিত কোন উপায় না দেখে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা মোকাবিলা করে। বলে, পাগলী মানুষ, সেতো আমাদের মতো স্বাভাবিক নয়। যেখানে যাক একইভাবে সে চলবে। তাই বলছিলাম এবারের মতো তার একটা সুযোগ দেন। এর পরে যদি কখনো এরকম কিছু ঘটে, তখন তারে আর রাখুম না এলাকায়।
রনজিতের কথা শুনে ইমাম সাহেব বললেন, ঠিক আছে। রনজিতের কথাই থাকল। তবে পুরুষ মানুষেরও কিন্তু শরিয়ত মানা দরকার। নাহলে পরকালে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হইতে হইব।
সভাপতি বলেন, ইমাম সাহেব এর বাহিরে আমার কোন কথা নেই।
রনজিত কিছুটা হাফ ছেড়ে বাচে।
ছয়
পাগলীর প্রতি সহানুভূতির ছলে রনজিতের মধ্যেও দিন দিন ভোগের চিন্তা বেড়ে যায়। কিছু দিন আগে রাতের ঐ ঘটনা তাকে আরও বেশি কামুক করে তোলে। মাঝে মধ্যে পাগলী তার দোকানে রাতযাপন করে। অন্যরা যেখানে পাগলীর আঘাতের ভয়ে, মানসম্মানের ভয়ে ভেতরের জ্বালা প্রশমিত করতে সাহস পায় না, রনজিত অবলীলায় তা চরিতার্থ করে দিনের পর দিন। পাগলীও অবচেতন মনে রনজিতের এ রঙ্গলীলা মেনে নেয়। তার মনে রনজিতকে সে বিশেষ স্থান দেয়।
হঠাৎ একদিন বাজারে রাষ্ট্র হয়ে যায় পাগলীর অন্তঃসত্ত্বার খবর। ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে পাগলীর দৈহিক পরিবর্তনের কারণে। তার পেট দিনকে দিন আকারে বড় হতে থাকে। রনজিত বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। সে জানে এ অপকর্মের হোতা সে নিজে। তাই নানান কৌশলে পাগলীকে বাজার থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। অথচ এক সময় পাগলীকে বাজারে রাখার জন্য বাজার কমিটির দ্বারস্থ হয়েছিল। আজ আবার নিজের দোষ ঢাকার জন্য পাগলীকে বাজার থেকে তাড়াতে বাজার কমিটির সভাপতি ও বাজার মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলে, সেদিন পাগলীকে বাজারে রাখার অনুরোধ করাটা তার ভুল ছিল। এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিকার না করলে বাজারে ব্যবসায়িদের ইজ্জত মান সব জলে ভেসে যাবে। বাজার কমিটি ও ইমাম সাহেব বিষয়টা আমলে নেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় পাগলীকে বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়ার। তারপর কোন একদিন রাতে পাগলীকে বাজার থেকে অনেক দূরে এক অজানা জায়গায় রেখে আসে।
রনজিত চিন্তামুক্ত হয়। মনে মনে ফরিয়াদ করে বলে, হে আল্লাহ এ যাত্রায় আমাকে রক্ষা কর। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিও বোধ করে। তার কেন যেন মনে হয়, হঠাৎ পাগলী বাজারে হাজির হতে পারে। দিন যায় মাস যায়। কিন্তু পাগলীকে দেখা যায় না। রনজিত কিছুটা আশ্বস্ত হয়। এভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হয়।
তারপর কোন এক কাক ডাকা ভোরে বাজারে অবস্থানরত কয়েকজন পাগলীকে রনজিতের দোকানের দক্ষিণ পাশের কদম গাছটার নিচে বাচ্চা প্রসবরত অবস্থায় দেখতে পায়। অচেতন পাগলীকে দেখে সোরগোল শুরু হয়। আস্তে ধীরে সকল মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। রনজিত একরকম মানসিক দুঃশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে।
বাজারের শতশত মানুষ এসে কদম গাছটার নিচে ভিড় জমায়। নানান জনে নানান কথা বলতে থাকে। কেউ বলে, বাচ্চাটা কার এটা বের করতে হবে?
আর একজন বলে, ওরে পাথর ছুড়ে মার। ও নষ্টা।
রনজিতও ভিড়ের মধ্যে এ-ওর মাথার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। মানুষের হট্টগোল থেকে কে একজন বলে, সবাই সরে দাড়াও, ইমাম সাহেব আসতেছে।
সবাই সরে গিয়ে ইমাম সাহেব ও কমিটির সভাপতির কদম গাছের নিচে আসার পথ দেয়।ইমাম সাহেব অত্যান্ত ঘৃণাভরে বলেন, এসব কিয়ামতের আলামত। এর বিহিত শরীয়ত মোতাবেক নিতে হইব। তানাহলে ঈমান আকিদা কিছুই থাকব না।
সভাপতি বলেন, ইমাম সাহেব এর বাহিরে আমার কি বলার আছে।
রনজিত খুশি হয়। ভীড়ের মধ্যে মান্নান দোকানদারও ছিল। সেও খুশি হয়।
তবে গুটিকয়েক যুবক বলে, শুধু কি পাগলীর একার দোষ? ওরে যে সর্বনাশ করেছে তারে খুঁজে বের করেন?
ইমাম সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, বিচার তোমরা করবা না আমি করব?
সবাই আপনি করেন, আপনি করেন বলে চিৎকার করে। তখন ইমাম সাহেব বলেন, তাহলে চুপচাপ থাকেন। দেখেন আমি কি করি।
ভোগবঞ্চিত মান্নান বলে, ইমাম সাহেব, তারপরও একটা কথা থেকে যায়। কে কামডা করলো বের করলে ভালো হতো না?
ইমাম সাহেব বলেন, যে এই কাম করছে সে নিশ্চয়ই আমাদের সমাজের কেউ? কি বলেন আপনারা?
সবাই হ হ বলে চিৎকার করে। ক্ষীণ কন্ঠে রনজিতও বলে, হ হ।
তখন ইমাম সাহেব বলেন, কোথাকার কোন পাগলীর জন্য আমাদের সমাজের কাউকে শাস্তি দিয়ে কি লাভ।
সভাপতি বলেন, ঠিকই তো।
সভাপতিও হাফছেড়ে বাঁচে। সেও একদিন জোর করে পাগলীকে ভোগ করেছিল।
রনজিত অধীর আগ্রহে ইমাম সাহেবের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকে। দুঃশ্চিন্তায় তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
ইমাম সাহেব সিদ্ধান্ত দেয় নিষ্পাপ শিশুটা বাদে পাগলীকে একশ একটা ব্রেতা ঘাতের। সবাই খুশি হয়। অনেকে বলে, ব্যাভিচারের এরকম শাস্তি হওয়া উচিত। রনজিতের খুব কষ্ট হয়। সে এই সমস্যার থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কিন্তু এমন কঠিন শাস্তি পাগলীর হোক তা সে চায়নি।
সাত
ব্রেতাঘাতে ক্ষতবিক্ষত পাগলী ডুগরে কেঁদে ওঠে। প্রাণপনে বাচ্চাটাকে আগলে রাখে। রক্তে সমস্ত শরীর ভিজে যায়। ঢুলতে ঢুলতে বাজার ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ভিড়ের মধ্যে রনজিতের মুখটা শেষবারের মতো দেখার চেষ্টা করে। শতশত মানুষের মাথার ফাঁক দিয়ে ঝাপসা চোখে রনজিতের মুখ সে দেখতে পায়। করুন চাহনিতে একধরনের ঘৃণা ও ভালোবাসার মিশ্রণ দেখা যায়। আর কেউ না বুঝুক রনজিত তা বোঝে। তার ভেতরে ঠিক হৃদপিন্ডে পাগলীর মতো কে যেন ব্রেতাঘাত করে। ঢুলু ঢুলু চোখে শেষবারের মতো রনজিতকে দেখে পাগলী। তারপর রক্তাক্ত দূর্বল শরীর নিয়ে সামনে এগোতে থাকে।
মানুষের সমাগম ভেঙে যায়। রনজিত দূর দৃষ্টিতে পাগলীকে দেখতে থাকে। একসময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
পরেরদিন বাজারের উত্তর পাশের নদীতে পাগলী আর তার বাচ্চাটির লাশ ভেসে ওঠে। উৎসুক মানুষ নদীর পাড়ে ভিড় জমায়।
কবির অন্য কবিতা:
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]