বিশ্ব শান্তি মিশনে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র কেন? | তানজিব রহমান

:: তানজিব রহমান ::
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

বিশ্বে নিজেদের ক্ষমতার প্রভাব বলয়কে ঠিক রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানারকম নিষেধাজ্ঞাকে নিজেদের কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে নিষেধাজ্ঞা পাল্টা নিষেধাজ্ঞা যদিও এখন একটি ভোঁতা অস্ত্র। নিজেদের প্রভাব বলয় ধরে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহন করছে নানান কূটকৌশল যার একটি হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে এনইডি’র (ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম, বেসরকারী সংস্থা (এনজিও), ও তাদের লালিত কিছু সুশীলকে মোটা অংকের অর্থায়নের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন বা কোন ষড়যন্ত্র বস্তবায়ন করার জোর প্রচেষ্টা। আর এই এনইডি’র (ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি) পেছনে রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।

বিতর্কিত গণমাধ্যম নেত্র নিউজ যে এনইডির অর্থায়নে চলে তা স্বীকার করে গেছেন নেত্র নিউজ ছেড়ে যাওয়া ডেভিড বার্গম্যান যিনি বিতর্কিত এ সংবাদ মাধ্যমটির ইংরেজী বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। ঘটনা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে নেত্র নিউজের বিতর্ক ছড়ানোর জালে এখন সম্পৃক্ত হয়েছে জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচেভেলে বাংলা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নেত্র নিউজ ও ডয়েচভেলের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন “Torturers deployed as UN peacekeepers” এবং ইউটিউব ভিডিও ডকুমেন্ট “From torturers to peacekeepers” যা বাংলাদেশ বিরোধী নতুন ষড়যন্ত্র। যেখানে টার্গেট করা হয়েছে শান্তি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) কে জড়ানো হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকেই একে বাংলাদেশ বিরোধী নতুন ষড়যন্ত্র বল্লেও তা মোটেও নতুন নয় বরং র‌্যাবকে বিতর্কি করার প্রচেষ্টা ২০১৪-১৫ সাল থেকে একটি চক্র বার বার করে আসছিল। বলা যেতে পারে নতুন মোড়কে পুরনো বিষ।

ডয়েচেভেলের বিতর্কিত প্রতিবেদনটি সবার মনে প্রশ্ন তুলে কয়েকটি ঘটনার সরলিকরণের মধ্যদিয়ে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করেন ১৪-১৫ মে, ২০মে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির পরের দিনই ২১মে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় । এটাকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে বাদ দেয়ার নতুন ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন অনেকে। এর সাথে মার্কিন মদদের একটি যোগসূত্রও দৃশ্যমান। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি তাদের এ তথ্যচিত্রকে আরো বিতর্কিত করেছে। কারন তারা মানবাধিকার মুখোশের আড়ালে ডোনার কান্ট্রিগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও অন্য দেশে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশে যখন মানবাতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছিল তখন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুরোধ করেছিল তাদেরকে যেন মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা না হয়, গ্রেনেড হামলা ও জঙ্গি হামলার অন্যতম আসামি মুফতি হান্নানের ফাঁসিতেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জঙ্গীদের পক্ষ নিয়েছিল। অনুরোধ করেছিল তাকেও যেন ফাঁসি দেয়া না হয় কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা হয়েছে তা নিয়ে তাদের কোন কোন মাথা ব্যাথা নাই। তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিতর্কিত ভূমিকা আবারো ধরা পড়লো ডয়েচ ভেলের বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্রে।

বাস্তবতা হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ একটি বড় অংশীদার। ৩৭ বছর ধরে ব্লু-হেলমেটের গৌরবান্বিত অধ্যায় বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশর নাম উজ্জ্বল করেছে। একটি মহল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশি সদস্যদের বাদ দিতে অপতৎপরতা শুরু করেছে। সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে শান্তিরক্ষীদের প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রচারণা এরই অংশ হতে পারে বলে তাদের ধারণা। কারণ ২৯মে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস ঠিক তার কদিন আগে এমন প্রতিবেদন হীন স্বার্থ চরিতার্থের একটি মহড়া বলা যায়। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, দু-একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হতে হবে। ঢালাও অভিযোগ করলে হবে না। আর এ ধরনের অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বাদ দেওয়া যাবে না। এ প্রক্রিয়া এত সহজ নয়, খুবই জটিল। কারণ গত ৩৭ বছরে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব, চৌকস পদচারণার সুনাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনীর ১৫ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল ইরাক-ইরান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের পতাকাতলে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। এক বছর পর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ নামিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী মোজাম্বিক এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে ৩৭ বছর ধরে শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছে সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ। পেশাদার মনোভাব, অবদান ও আত্মত্যাগের ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থানও সুসংহত করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী শান্তি ও মানবাধিকারের পতাকা গেড়ে দিয়ে আসার এ তালিকায় আরো আছে সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, সুদান, সাউথ সুদান, গণতান্ত্রিক কংগো, মালি, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমোর, নেপাল, লেবানন এবং কুয়েত। সিয়েরা লিওনের জনগণ এখনও বাংলাদেশী সস্ত্রবাহিনীর অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বর্তমানে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর মোট কয়েকটি মিশনে ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী তাদের মিশন শেষ করেছেন। তাছাড়া মিশন এলাকায় সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। বিশ্বের ৪৩টি দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছেন।
ডয়েচভেলের এ প্রতিবেদনে র‌্যাবকেও বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে যারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নির্মূলে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৩৩ ঘণ্টার অভিযানে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আমির শায়খ আবদুর রহমানকে সিলেটের শাপলাবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অভিযানটি সবচেয়ে বড় সাফল্য বাহিনীটির। পরে গ্রেপ্তার করা হয় সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানিসহ বিপুলসংখ্যক জঙ্গি। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠনের মুখোশ উন্মোচন ও তাদের গ্রেপ্তারেও র‌্যাবের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বর্তমানে জামায়াতুল আনসার আল হিন্দাল শারক্বীয়ার অপতৎপরতা উদঘাটনেও র‌্যাবের অগ্রণী ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। সুন্দর বনকে দস্যু মুক্ত করণে বা মাদক চোরাচালন বন্ধেও এ বিশেষ বাহিনীর আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার পরও মিথ্যা তথ্যকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের অর্থলগ্নি লবিস্টরা মার্কিন প্রশাসনকে ভুল তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে মিথ্যা বুঝিয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কানভারী করে যাচ্ছে চক্রটি।
এ চক্রের পেছনে যারা কাজ করছে তারা সবসময়ই বাংলাদেশকে পেছনে টেনে ধরতে চেয়েছে, কখনো গ্রেনেড হামলা, কখনো বোমা হামলা-গুলি, সবকিছুতে ব্যার্থ হয়ে এখন করছে লবিস্ট নিয়োগ, বিদেশী সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশী শান্তি রক্ষীদের পথ রুদ্ধ করতে পারবে না। কারণ এরই মধ্যে বিশ্বে তাঁরা শান্তি ও সৌহার্দের দূত হিসেবে নিপিড়িত মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক: তানজিব রহমান, লেখক ও গবেষক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]