ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এখন অনেকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করছেন। সবচে বেশি আলোচিত হচ্ছে তার বিচক্ষণতা নিয়ে। বাইডেন তো গত রোববার বলেছেন, নেতানিয়াহু একজন ভালো গ্র্যান্ড মাস্টার , দাবাড়ু।
দ্য গার্ডিয়ানে বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক সিমন টিসডল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন গত মঙ্গলবার, যে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য আসলে ইসরায়েলের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, নেতানিয়াহু এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মারলেন।
নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা নিখুঁত ও ছক সূদুরপ্রসারী। যেমন ইরান থেকে হামলা হোক এটাই তিনি চেয়েছিলেন। এই হামলা তাকে একটু সুযোগ করে দিল। এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। এই হামলা ইরানকে সরাসরি আক্রমণের বৈধতা দিল। ইরান বহু বছর ধরেই ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ও সম্ভাব্য ধ্বংসকারী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
ইসরায়েলে ইরানের হামলায় গুরুতর কোনো ক্ষতি হয়নি। ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা ৯৯ শতাংশ মিসাইল ও ড্রোন ধ্বংস করেছে। ক্ষয়ক্ষতি সামান্যই। তেহরান এখন বলছে, এই পর্বের সমাপ্তি এখনই। কিন্তু হামলা হলে পাল্টা হামলার ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে তারা।
এখন প্রশ্ন তাহলে শেষের দিকে কি ঘটতে পারবে ? ইসরায়েলি মন্ত্রী বেনি গানজ তো বলেছেন, আঞ্চলিক জোট গঠন করে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাবে, সময় ও ইচ্ছেমতো।
গোপনে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সমর্থন তো রয়েছেই ইসরায়েলের প্রতি। ইরানের হামলার পর ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সমর্থন পেতে পেতে যাচ্ছে ইসরায়েল।
একইসাথে বিশ্বের গণমাধ্যমে যেসব খবর এতোদিন প্রকাশিত হয়েছে ইসরায়েলের বাহিনী ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে , ইসরায়েল মারমূখী সেটা বুল প্রমাণিত হলো ইরান হামলা করার পর। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রমাণ করতে চাইছেন মুসলিম বিশ্ব মানেই টেররিজম ।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। হত্যা ও হামলার বহু ঘটনা ঘটিয়েছেন। পরমাণুবিজ্ঞানী ও ইরানের ভাড়াটে বাহিনীর সৈন্যদের খুনের দায় স্বীকার না করলেও গুপ্ত হত্যা চলেছে অবাধে।
কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের এই তালিকার ব্যাপ্তি আরও বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইরানের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ রাজি মৌসাভি দামেস্কে খুন হন। ইরানের প্রতিক্রিয়া তখনো ছিল পরোক্ষ ও দুর্বল। সিরিয়ার রাজধানীতে ইরান দূতাবাসের বর্ধিত অংশে বোমা হামলার পর দেশটির প্রতিক্রিয়ার ধরন বদলে দেয়। ওই হামলায় দেশটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা খুন হন। সার্বভৌমত্বে নির্লজ্জ আঘাত হানার জন্য ইরান ইসরায়েলকে দায়ী করেন।
নেতানিয়াহুর মতো খামেনি এবং ইরানের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির হাতে আরও বিকল্প ছিল। ইরান তার এই ক্ষোভের কথা জাতিসংঘে কিংবা হেগের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে তুলতে পারত। তারা জি–টোয়েন্টি কিংবা ব্রিকসে তাদের মিত্রদের সহযোগিতা নিতে পারত। ইরান পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েও চুপ করে থাকতে পারত। এভাবে তারা বৈশ্বিক দক্ষিণের পশ্চিমা বিরোধী দেশগুলো, যেমন চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতা পেতে পারত। কিন্তু তারা হামলাই করেছে।
ইরান মনে করছে তাদের পাশে চীন ও রাশিয়া রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা এমন চীন নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া এ মূহূর্তে কিছুই ভাবছে না। যুদ্ধে জড়ানো তো বহুদূরের কথা। তবে চীন উস্কানি দিতে কখনো পিছুপা থাকে না। অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেন সমস্যা নিয়ে রয়েছে সংকটে। তারাও তেমন ইরানের পক্ষে দাড়াবে বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ এখন আর ছায়াযুদ্ধ থাকছে না, এই যুদ্ধ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে । আর এই যুদ্ধ বাধিয়েছেন নেতানিয়াহু। তিনি জানতেন তেহরান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাবে। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তিনি তাঁর মার্কিন মিত্রদের এই হামলা সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত করেননি। হয়তো মার্কিন প্রশাসন আগে জানলে হামলায় ভেটো দিত।
ধরন দেখে মনে হয়, নেতানিয়াহু দেশের ভেতর তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখা, মার্কিনদের অন্ধ সমালোচনাকে দমানো এবং ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপকে থামিয়ে দিতে এই হামলা চালিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর কূটকৌশল কাজে লেগেছে। রাতারাতি গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াশিংটনের যে বিরক্তি, তা মিলিয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি কিংবা ইসরায়েলি জোটের প্রতি শর্তহীন সমর্থন প্রত্যাহারে চাপ বাড়ছিল। সেটাও মিইয়ে যেতে সময় লাগবে না। যুক্তরাজ্য বরং সিরিয়া ও ইরাকের আকাশে সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে।