যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে এত সামরিক ঘাঁটি কীভাবে স্থাপন করল? কেন করল?

::
প্রকাশ: ২ years ago

পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক: 
সারা বিশ্বে আমেরিকার প্রায় ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ইরাকে যেসব ঘাঁটি এখনো চালু রয়েছে সেসব ঘাঁটিকে বিবেচনায় নিলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এসব ঘাঁটি পরিচালনার জন্য প্রতি বছর প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ডেভিড ভাইন তার ‘Base Nation’ গ্রন্থ এবং রাশিয়ার বার্তা সংস্থা স্পুৎনিক থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে ‘Base Nation’ গ্রন্থে’ অধ্যাপক ভাইন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি পরিচালনার কারণে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং মানুষের জীবনহানি হচ্ছে তার একটি হিসাব নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। অবাক করা তথ্য হচ্ছে- ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের কাজ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তবে সারা বিশ্বে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বেশিরভাগ আবির্ভূত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সে সময় আমেরিকা বিশ্বনেতায় পরিণত হয় এবং জাপান ও জার্মানিতে শান্তিরক্ষীর দায়িত্ব পালন করে। কোরিয় উপদ্বীপের যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধও বিভিন্ন দেশে মার্কিন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার কাজ জোরদার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমিউনিজম বিস্তারের অজুহাত দেখিয়ে সারা বিশ্বে দ্রুতগতিতে আমেরিকা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্বে তার ভূ-রাজনৈতিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ক্ষুন্ণ করার চেষ্টা করে।

বর্তমানে ৮০টি দেশের সেনাঘাঁটি, বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান, নিজেদের দূতাবাসের নিরাপত্তা ইত্যাদি কাজসহ সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার সৈনিক মোতায়েন রয়েছে বিদেশে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এসব ঘাঁটি পরিচালনার জন্য প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।

জাপান, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো যেখানে গণতন্ত্র সুসংহত রয়েছে। তারপরও এসব দেশে বহুসংখ্যক মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে এবং এসব দেশে আমেরিকার হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও আমেরিকা তার ঘাঁটি অক্ষত রেখেছে এবং সেসব ঘাঁটিতে সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

 

কার অর্থে পরিচালিত হয় এসব ঘাঁটি? 
মার্কিন সরকার সারা বিশ্বে ৮০০ সামরিক ঘাঁটি পরিচালনার জন্য আমেরিকার জনগণের কাছ থকে ট্যাক্স আদায় করে এবং সেই অর্থে ঘাঁটিগুলো পরিচালিত হয়। রাশিয়ার বার্তা সংস্থা স্পুৎনিকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে মোতায়েন একজন সেনার জন্য মার্কিন করদাতাদেরকে বছরে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার ট্যাক্স দিতে হয়। পরোক্ষভাবে বিশ্বের বহু দেশের জনগণকেও বহন করতে হয় সে অর্থ। কারণ বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ’র মাধ্যমে আমেরিকা নানা কায়দায় বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। এ দুটি সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকা বিভিন্ন দেশের কাঁধে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। সারা বিশ্বের অর্থনীতির একক নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আমেরিকা বিশ্ববাসীর ঘাড়ে তার ঋণ ও ব্যয়ের ভাগ চাপিয়ে দিচ্ছে তা নতুন কিছু নয়। অন্যদিকে, এসব মার্কিন সেনাদের নানা রকম অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। এর মধ্যে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপে বহুসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে মার্কিন সেনারা। আর ইরাক ও আফগানিস্তানে তো হেন অপরাধ নেই যা মার্কিন সেনারা করে নি। এমনকি, শিশুদের ওপর গুলি করার প্র্যাকটিসও করেছে; খেলতে খেলতে মানুষ হত্যা করেছে। কার হাতে কত ‘এইম’ তার পরীক্ষা করেছে আফগান শিশুদের ওপর। অভিযানের নামে আফগানিস্তান ও ইরাকের বহু পরিবারের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে এবং আফগান নাগরিকদের হত্যার পর তাদের মুখে প্রস্রাব করার মতো ঘৃণ্য ঘটনাও মার্কিন সেনারা ঘটিয়েছে।

 

কেন সামরিক ঘাঁটি:
স্থল, বিমান ও নৌ ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে সারা বিশ্বে ব্যাপক মাত্রায় আমেরিকা সামরিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে আর এর মাধ্যমে তার একক প্রভাব নিশ্চিত হয়েছে। এসব ঘাঁটির মাধ্যমে মূলত সারা বিশ্বে আমেরিকা তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়; সেইসঙ্গে চায় দেশে দেশে অনুগত শাসক শ্রেণি তৈরি করতে। যেখানে বাধা দেয়া হয় সেখানেই সেনা অভিযান কিংবা গোপন মিশনে বাধা সৃষ্টিকারী শাসককে সরিয়ে দেয়া হয়। বিশ্বের সব দেশে ও সব অঞ্চলে ‘গোলাম’ মানসিকতার শাসক শ্রেণিপাওয়া যাবে না। ফলে সামরিক শক্তি ও ঘাঁটি বাড়ানোর বিকল্প কোনো চিন্তা আপাতত আমেরিকার মনে নেই। কথায় কাজ না হলে সামরিক বাহিনী দিয়ে সব ব্যবস্থা করা হয়।

মার্কিন এসব ঘাঁটি আমেরিকার সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে তার কৌশল বাস্তবায়নের পথ করে দিয়েছে। এ কারণে সহজে সে কৌশলে পরিবর্তন আসবে- তা ভাবার সুযোগ নেই। বরং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় কথিত সন্ত্রাসী হামলার পর এ পর্যন্ত সাতটি দেশে নতুন করে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে মার্কিন সরকার। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৮০টি দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ঘাঁটির জন্য ৮,৪৫,৪১১টি ভবন ও সরঞ্জামাদি রয়েছে আর জায়গা নিয়েছে তিন কোটি একর। সে হিসাবে পেন্টাগন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভূমি-মালিক। বলার অপেক্ষা রাখে না- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব খনিজ সম্পদ রয়েছে তার ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আমেরিকার বড় লক্ষ্য। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতি ও তার আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করাও আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এসব লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে সামরিক দিক দিয়ে একক অধিপতি হয়ে বসা ছাড়া আমেরিকার কথা গুরুত্ব পাবে না মার্কিন সরকারের সামনে সে বিষয়টি পরিষ্কার।

 

কোন দেশে কত ঘাঁটি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, জার্মানি ও ইতালি ছিল এক পক্ষে এবং তারা পরাজিত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষের আজ ৭০ বছর পর জার্মানিতে ১৭২টি, ইতালিতে ১১৩টি এবং জাপানে ৮৪টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। কোরিয় উপদ্বীপের যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৬৭ বছর আগে। এত বছর পরও দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে ৮৩টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিলা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, সৌদি আরব, কাতার ও কেনিয়াসহ বিশ্বের ৮০টি দেশ ঘাঁটি গড়ে তুলেছে আমেরিকা।

ইরানকে ঘিরে যত ঘাঁটি:
আঞ্চলিক মানচিত্রের দিকে তাকালে একদম সহজেই চোখে পড়বে ইরানের দুই পাশে মার্কিন বাহিনীর অন্তত ১৯টি ঘাঁটি ছিল। ২০২১ সালেরপ্রায় শেষ ভাগ পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজমান ছিল। তবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার পর ঘাঁটির সংখ্যা কয়েকটি কমেছে। আর মধ্য-এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোকে বিবেচনায় নিলে ইরানকে ঘিরে থাকা মার্কিন ঘাঁটির সংখ্যা অন্তত ২৫টি। তবে, বহু সংখ্যক গোপন ঘাঁটিও রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সে কারণে সব ঘাঁটির কথা জানা সম্ভব নয়। গ্লোবাল রিসার্চে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, বিশ্বের ১৫৬টি দেশে আমেরিকা ৩,৫০,০০০ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে। এসব সেনা প্রয়োজন হলে যেকোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বে খুব কম দেশ আছে যারা মার্কিন সরকার থেকে নিরাপদ।

মধ্যপ্রাচে রয়েছে আমেরিকার বহুসংখ্যক ঘাঁটি। এসব ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের কাতার শাখার ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড রিজিওনাল স্টাডিজ’র পরিচালক মেহরান কামরাভা। তিনি বলেছেন, তিনটি কারণে আমেরিকা মধ্যেপ্রাচ্যে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে; এগুলো হলো- মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সম্পদেও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ইহুবিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার গ্যারান্টি এবং এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি মোকাবেলা করা। বলা বাহুল্য, এ চিত্র থেকে বিশ্বে আমেরিকার আগ্রাসী চরিত্রও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইরানের দক্ষিণে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মোতায়েন রয়েছে মার্কিন বিমান, স্থল, নৌ ও মেরিন সেনা। পশ্চিমে তুরস্ক ও ইসরাইলে সেনা মোতায়েন করা রয়েছে। এছাড়া উত্তরে তুর্কমেনিস্তান ও কিরগিজস্তানে এং পূর্বে পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন রয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে ইরানের আরেক প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইরানের প্রতিবেশি দেশ কুয়েতে রয়েছে মার্কিন বিমানঘাঁটি এবং বাহরাইনের রয়েছে মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের সদরদপ্তর।

পঞ্চম নৌবহরে রয়েছে অন্তত ১৬,০০০ সেনা এবং ৪০টি ছোট বড় জাহাজ। এছাড়া, পারস্য উপসাগরে বহুসংখ্যক মার্কিন যুদ্ধজাহাজের নিয়মিত উপস্থিতি রয়েছে। আর সৌদি আরবের এস্কান এলাকায় মোতায়েন রয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনী। ইরানের সঙ্গে কখনো সামরিক সংঘর্ষ শুরু হলে তুরস্ক, ইসরাইল, জিবুতি ও ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপপুঞ্জ থেকে সহজেই মার্কিন সেনারা তাতে সহায়তা করতে পারবে। ইরানের আশপাশের বিভিন্ন দেশে মার্কিন কমান্ডো মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্মি গ্রিন বেরেটস এবং রেঞ্জার্স, নেভি সিল, বিমান বাহিনীর কমান্ডো এবং মেরিন কোরের স্পেশাল অপারেশন্স টিম।

মার্কিন সরকারে পাশাপাশি একইভাবে ব্রিটিশ সরকারেরও বিভিন্ন দেশে ঘাঁটি রয়েছে। তারা সবসময় মার্কিন সরকারের অনুগামী। বিশ্বে আমেরিকা আর ব্রিটেনের স্বার্থ অনেকটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই দুই শক্তির স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সৌদি ও তুরস্কসহ কয়েকটি আরব দেশ। এ অবস্থায় বলা যায়- পশ্চিমাদের স্বার্থের বরকন্দাজ হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর দায়িত্ব পালন যতদিন বন্ধ না হবে ততদিন পর্যন্ত বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে সার্বিক কল্যাণ আসবে না; মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে নিজেদের স্বার্থ, ভাবতে হবে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থের দিকটি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাধারণ মানুষ আঞ্চলিক সম্প্রীতি দেখতে বেশি পছন্দ করে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বা ব্রিটিশ বেনিয়াদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা দেখতে চায় না তারা।