শেখ হাসিনার জয় ভারতের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে | শর্মিলী মাহজাবিন

:: শর্মিলী মাহজাবিন ::
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ১২ তম সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। বিরোধী দলগুলো, বিশেষত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির টানা হরতাল-অবরোধ ও নির্বাচন বর্জন সত্ত্বেও প্রায় বিশৃঙ্খলাবিহীন ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমমনা ১৮টি দল অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকলেও ছোট-বড় ২৯টি দল অংশ নিয়েছে। ফলাফল ঘোষিত ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২টি ও জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১টি আসনে জয়লাভ করেছে।
সহিংসতার আশঙ্কা ও বিভিন্ন অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করেছে বলে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা জানিয়েছে। মোট ভোটারের ৪১ শতাংশ ভোট কাস্টিং হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যা ২০১৮ সালের নির্বাচন এবং অন্যান্য আগের নির্বাচনের তুলনায় বেশ কম। তবে নির্বাচনের আগে অনেক বিশ্লেষক যেমন ভোটারবিহীন নির্বাচনের আশঙ্কা করেছিলেন ভোটার উপস্থিতির এই হার সেসব আশঙ্কাগুলোকে ভুল প্রমান করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে উল্লেখ করেছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। যুক্তরাজ্যও নির্বাচনের সময় ‘ভীতি প্রদর্শন ও সহিংস কাজ’-এর সমালোচনা করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান অনেকটাই অনুমেয় ছিল, কারণ তারা নির্বাচনের আগেও বারবার তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ সহ বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে রাশিয়া ও চীন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিদ্বয় সংবিধান অনুযায়ী একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ফোনকলে ও চিঠিতে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রী মোদি লিখেছেন, ‘সফল নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণকে আমি অভিনন্দন জানাই। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে অবিচল ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ জয়ের নির্বাচন জয়ের পরদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের একটি ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ এবং প্রতিবেশী দুই দেশ দ্বিপাক্ষিকভাবে অনেক সমস্যার সমাধান করেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই বিজয় ভারতের জন্য বেশকিছু দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
ফলে নির্বাচনের আগে অন্যান্য বৃহৎ শক্তির বিপরীতে ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অভিহিত করে কোনরকম মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর জোর দিয়ে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা জানিয়েছিলেন যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপের সময় ভারত প্রতিবেশী দেশের প্রতি তার ’দৃষ্টিভঙ্গি’ ’খুব স্পষ্টভাবে’ জানিয়ে দিয়েছে। কোয়াত্রা বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এবং বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।’ সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন নির্বাচনের পর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের পরিবর্তন হলে সেটি টু প্লাস টু বৈঠকের সময়েই ঘটেছে।
অর্থনৈতিক বিকাশ, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষত, বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের কৌশলগত নৈকট্যের কারণে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো ঢাকায়ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে সতর্ক ভারত। বাংলাদেশে ব্যাপক চাইনিজ বিনিয়োগের কারণে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও ভারত বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার হিসেবেই রয়ে গেছে। ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেখানে একেবারেই বাণিজ্যিক, ভারতের সঙ্গে সেখানে সম্পর্ক পুরোপুরি কৌশলগত। সুতরাং চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের সাথে তার স্থিতিশীল কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নির্বাচনী ইস্যুতে চীনের সাথে সমান্তরাল অবস্থান গ্রহণ করেছে।
এরইমধ্যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যখন সম্পূর্ণভাবে চীনের প্রভাববলয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে তখন একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেই নয়াদিল্লির জন্য একটি নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চীনকে প্রতিহত করতে ভারত তার প্রতিবেশী দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে তার শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। ভারতীয় সামরিক ভাষ্যকার মেজর জেনারেল (অব.) অশোক কে মেহতার মতে আশেপাশের বেশিরভাগ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারত বাংলাদেশের উপরই পূর্ণ আস্থা রাখছে। ফলে ভারত বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের উপর বহিরাগত চাপ এটিকে চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিতে পারে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্যতা অনেক ভারতীয় কর্মকর্তার বক্তব্যেই স্পষ্ট। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বেশ কয়েকবার বলেছেন যে ভারত একটি ’আস্থাভাজন অংশীদার’ হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং একটি ’শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ভবিষ্যতের জন্য তার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে যে শেখ হাসিনা কার্যকরভাবে এই অঞ্চলে চরমপন্থার বিস্তার রোধ করেছেন এবং আওয়ামী লীগকে দুর্বল করলে চরমপন্থী ও মৌলবাদী দলগুলোকে উৎসাহিত করবে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর সহায়তায় ভারত সফলভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে দমন করেছে।
বেশ কয়েকটি সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে, বাংলাদেশ ভারতের অনুন্নত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। স্থলবেষ্টিত অঞ্চলে পণ্য পরিবহন সহজ করতে বাংলাদেশ তার দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট অনুমোদন করেছে।
এছাড়া বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে ভারতের রপ্তানির পরিমান ১৬ বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত করেছে। সড়ক, রেলপথ, শিপিং এবং বন্দর সহ পরিবহন পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারত ৮ বিলিয়ন ডলারের তিনটি ঋণ সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে আগরতলা-আখাউড়া আন্তঃসীমান্ত রেললাইন, খুলনা-মংলা বন্দর রেল সংযোগ এবং মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ইউনিটের উদ্বোধন করেন।
সবশেষে, কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারতের তার প্রতিবেশী দেশে একটি নির্ভরযোগ্য সরকার প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘতম সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ভারতের জন্য এটিকে অশম্ভাবী করে তোলে। একারণে ভারত কেবল শেখ হাসিনার উপরই আস্থা রাখতে পারে, কারণ তিনি তার প্রায় ৪ বারের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ভারতীয় সংবেদনশীলতার প্রতি সচেতন ছিলেন। ফলে, নয়াদিল্লি পুনরায় শেখ হাসিনার ক্ষমতার ধারাবাহিকতাকে স্বাগত জানিয়েছে।

লেখক: শর্মিলী মাহজাবীন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]