আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, দলীয় চেয়ারপারসনসহ সব নেতাদের মুক্তির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। দাবি পূরণ না হওয়ায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না দলটি। তবে, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শামিল হয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা।
কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে, কেউ অন্য দলের, আবার কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এসব নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। বিএনপির কঠোর অবস্থান এই প্রার্থীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং ভোটের মাঠে জয়ী হতে মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন তারা। কারণ, তাদের জন্য এ নির্বাচন মর্যাদা ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
স্বতন্ত্রভাবে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বিএনপির সাবেক ও বহিষ্কৃত নেতা ১৩ জন। এর বাইরে তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম থেকে নির্বাচন করছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের আরও ১৯ জন সাবেক নেতা। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে সরাসরি যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন একজন। সব মিলিয়ে বিএনপির সাবেক নেতাদের মধ্যে অন্তত ৩৩ জন এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বগুড়ার চারটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির সাবেক চার নেতা। তারা হলেন— বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা। বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা। শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বিউটি বেগম বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হয়েছেন। বগুড়া-৭ (শাজাহানপুর-গাবতলী) আসনে প্রার্থী হয়েছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল।
ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনে নির্বাচন করছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ্ শহীদ সারোয়ার এবং ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির আরেকজন সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান।
টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আনোয়ারুল হক প্রার্থী হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। একসময় কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) থেকে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির সাবেক তিন সংসদ সদস্য। তারা হলেন— ফরিদপুর-১ আসনে শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, বরগুনা-২ আসনে আবদুর রহমান এবং সুনামগঞ্জ-৪ আসনে দেওয়ান শামসুল আবেদিন।
এছাড়া, বিএনএমের প্রার্থী হিসেবে রাজশাহী–৩ আসনে নির্বাচন করছেন রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে বিএনএমের হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র আবদুল মতিন। শেরপুর-১ আসনে বিএনএম থেকে প্রার্থী হয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
কুমিল্লা-৫ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক শওকত মাহমুদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। নির্বাহী কমিটি থেকে বহিষ্কৃত বিএনপির আরেক নেতা আবুল কাশেম ফখরুল ঝালকাঠি-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাহী কমিটির আরেক বহিষ্কৃত নেতা খন্দকার আহসান হাবিব টাঙ্গাইল-৫ আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য মাহাবুবুল হাসান।
বিএনপি ছেড়ে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচন করছেন বিএনপির অন্তত ১৩ জন সাবেক নেতা। তৃণমূল বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ ও তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্যরা হলেন মৌলভীবাজার-২ আসনের এম এম শাহীন, ঝিনাইদহ-২ আসনে নুরুদ্দিন আহমেদ ও মেহেরপুর-২ আসনে আবদুল গণি।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নাজিম উদ্দিন চট্টগ্রাম-৫ আসনে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি তাইজাল হক চুয়াডাঙ্গা-১, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মোজাফফর আহমেদ ঠাকুরগাঁও-২, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহ-সভাপতি আবদুল কাদির তালুকদার চাঁদপুর-৪ ও গাজীপুর মহানগর বিএনপির নেতা জব্বার সরকার গাজীপুর-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তারা সবাই বিএনপি ছেড়ে তৃণমূল বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনে তৃণমূল বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। শেরপুর-২ আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন শেরপুর জেলা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. জায়েদুর রশীদ। টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে তৃণমূলের হয়ে নির্বাচন করছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য খন্দকার ওয়াহিদ মুরাদ।
আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, সরাসরি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন একজন—শাহজাহান ওমর। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে ঝালকাঠি–১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সরাসরি বিএনপি থেকে সরকারি দলে যোগ দেওয়া এবারের একমাত্র প্রার্থী শাহজাহান ওমর।
বিএনপি নেতাদের স্বতন্ত্র ও অন্য দলের প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, এসব নেতা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এত বছর রাজনীতি করেও এরা বুঝতে পারেননি, কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক। যেহেতু, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে তারা নির্বাচন করছেন, তাই দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তা দলের জন্য ভালো হয়েছে।