আওয়ামী লীগ ২৬৮ (ডামিসহ), + জাতীয় পার্টি ২৬, + ১৪ দল (মহাজোট) ৬ = ৩০০। তাহলে বিরোধীদলীয় নেতা/নেত্রী কে হবেন, ডামিই…? (ডামির বাংলা- নকল, মূর্তি, সাক্ষিগোপাল, কৃত্রিম, সাজানো)। মজা না! ফিলিংলি ২য় স্থান নির্ধারণি খেলা! সাধারণ মানুষের সাথে কেমন ডিসহনেসটি গেইম? আদারওয়াইজ একটি ঝাকালো অনুষ্ঠান কেন নয়Ñ ‘বিরোধী দল তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’!
মাত্র কয়েকদিন পরেই (৭ জানুয়ারি ২০২৪) বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন না হওয়ার বা নির্বাচন কেমন হবে অথবা কারা জিতবে, প্রার্থীরা কে কার বিরুদ্ধে লড়ছেন, ফল কী হবে, দ্বিতীয় হবে কোন দল, কে সরকার গঠন করবে, কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী কে/কারা হবেন এসব নিয়ে কোনো খটকা, সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস বা অনিশ্চয়তা নেই। যা ঘটছে, যা ঘটবে সবাই জানে। আমরা জানি কী হতে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ জানে কী হতে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন জানে কী হতে যাচ্ছে, সর্বসাধারণও জানেÑ ভোট দিতে যাক বা না যাক, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকছে! বলতেই হয়, শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে ২০২৪ সালের নির্বাচন! তাই অগ্রীম শুভেচ্ছা ‘মহাবিজয়ী’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হারবেও আওয়ামী লীগ, জিতবেও আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতবেন, তারা তো আওয়ামী লীগেই থাকবেন। একই দল থেকে সরকারি ও বিরোধী দল! আসলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মূল লড়াইটা যে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও অমনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে হবে, তার আলামত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। ঘোষণা দিয়ে সরকারি দল ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে এবং একই সঙ্গে কথিত স্বতন্ত্র, একই দলের, অথবা সহযোগী দলের প্রার্থীদের দাঁড় করানো হয়েছে। জনগণ যাকেই ভোট দিক সমস্যা নেই। অফিসিয়াল আওয়ামী লীগ প্রার্থী হারলেও জয়ী হবে ‘ডামি’ স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ। এভাবে একটি দেশের নির্বাচন হতে পারে? এমন নির্বাচন এ ধরাধামে সত্যিই বিরল! এবার মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোটের সঙ্গে নেই। আসলে মনের তাগিদ না থাকলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। বাংলাদেশ এক অনির্ধারিত গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে কী? আমরা কি অজানা পথের যাত্রী? কোথায় গিয়ে পৌঁছবো আমরা? জবাব কার কাছে? রাজনীতিতো দেশের ও মানুষের কল্যাণের জন্য, অকল্যাণ ডেকে আনার জন্য নয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল, ইলেক্ট্রনিক্স ও পেপার মিডিয়াগুলোয় সরব দেশের বুদ্ধিজীবী মহল। এমনটা অতীতের সব সরকারের আমলেও দেখা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, নতুন সরকার ভালোভাবেই দেশ চালাতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না। আসলে এদের মত দলদাস, দলকানা, বিক্রিত ‘বিদ্যান’দের জন্যই শাসকগণ বরাবরই ভয়ানক হয়ে থাকে। গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করে যে দেশের জš§ হয়েছে, সেই দেশের শিক্ষিত লোকেরা (বুদ্ধিজীবী/ আমলা) যারা রাষ্ট্রের অংশ তারা গণতন্ত্রের অন্তিম যাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন কীভাবে? রাজনীতিবিদগণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রকে ঝুট বানিয়ে ফেলেছে! কাজেই আমরা এই ‘ঝুট গণতন্ত্রের’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চাই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তো বলেই দিয়েছেন, ‘কেন্দ্রের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, প্রয়োজনে ১০ বার ভোট নেব’। আসলে তিনি একজন অনেক বড় ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। কথাও বলেন অনেক উঁচু মানের। যার মাহাÍ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বোঝার মতো জ্ঞান ক’জনার আছে?
বাংলাদেশে যখনই যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা নির্বাচনকে নিজের পক্ষে নিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। বিএনপি সরকার বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়িয়ে প্রথম বিতর্কের জš§ দেয়। ২০০৮ এ বিএনপি কেন ২৯টা সিট পেয়েছিল? কেন ২০১৮তে ড. কামাল হোসেনকে ভাড়া করে আনতে হলো? সমস্যার মূল কোথায়, তা বিএনপিকে খুঁজে নিতে হবে। সরকারের দায় আছে সকল দলকে নিয়ে, সবার আস্থা অর্জন করে নির্বাচন করার। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিপ্রেক্ষিত তার জন্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে দোষ দিলে ভুল হবে। বিএনপির অনেক দায় আছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। তারাও বর্তমানের আওয়ামী লীগের মতো ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলো, পরেনি, কিন্তু আওয়ামী লীগ পারছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এ-ই যা পার্থক্য। বাস্তবে বিএনপি-আওয়ামীলীগ একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকার পরও সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হানাহানি ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলের আগ্রহী সদস্যদেরকে, যারা দলীয় মনোনয়ন পাননি, তাদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে উৎসাহিত করেছে। যদিও তাদেরকে ‘ডামি প্রার্থী’ বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এতে নিজ দলের মধ্যে হানাহানি, রক্তারক্তি, খুনোখুনি আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে বহুগুণ বাড়বে। আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলকে নির্বাচনে এনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে চেয়েছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। নির্বাচনে অধিক সংখ্যক দল অংশ নিলে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে। এতে এমন একটি ধারণা তৈরি হবে যে, নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। অর্থাৎ, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আবহ সৃষ্টি করতে ডামি প্রার্থী দাঁড় করানো! নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মরিয়া। নজিরবিহীনভাবে তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেদের দল থেকেই স্বতন্ত্র ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করানোর। একদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীর প্রচারণা এখন জমে উঠেছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থক ও ডামি প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি, সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একসময়ের উজ্জ্বল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আওয়ামী লীগ আজ পথ হারিয়ে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থা ও বিশ্বাস তৃণখ-ের মতো এখন বাতাসে উড়ছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা শুধু লক্ষণীয় নয়, বড় ধরনের গবেষণার বিষয় হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল নিু ও মধ্যবিত্তের দল এবং তাদের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। একটানা ২০ বছর ক্ষমতার মধ্যে থাকায় এ দলে বিত্তবান, সাবেক আমলা, ব্যবসায়ী এবং সুবিধাবাদী অনেকের অনুপ্রবেশ ঘটবে। তাতে প্রকৃত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদের অভাব যেমন এখনই দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও প্রকট হবে।
এমন নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক বন্ধনও বিপর্যস্ত হতে পারে। একটি অত্যাচারী, আরেকটি অত্যাচারিত পক্ষ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সমাজে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ বাড়বে। বেসিক্যালি আওয়ামী লীগ- আওয়ামী লীগেরই যে ক্ষতি করলো যা পুষিয়ে নেওয়ার শক্তি আওয়ামী লীগের কোন দিনও হবে কী? ২০১৪ এবং ২০১৮ এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আওয়ামী লীগকে যে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল, সেখান থেকে উত্তরণের পথে না হেঁটে তারা বরং সমস্যা আরও ঘনীভূত করলো। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হবে হয়তো; কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে পরাজয়ের পাশাপাশি দেশের আসন্ন সংকটের জন্যও ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগকে দাঁড়াতে হবে।
নব্বইয়ে জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিএনপির দুই মেয়াদ ছাড়া জাতীয় পার্টি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার হিস্যা পেয়ে এসেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার হিসেবে ২৭টি আসন পেয়েছিল। ২০১৪ সালের সংসদে একইভাবে বিরোধী দল ও সরকারের অংশীদার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদে তাদের আসন ছিল যথাক্রমে ৩৪ ও ২৭টি। যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। বিরোধী দলের আসন পাকা করতেই জাতীয় পার্টি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে। দলের ভেতরে সংকট হলেও দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হন। ফলে জাপার ভাগ্য যে আওয়ামী লীগই নির্ধারণ করে তা স্পষ্ট।
এ নির্বাচনে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, কথিত তৃতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে পরিচিত, ছোট ছোট দল, নতুন গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারি দলের কাছে বিজয়ের নিশ্চয়তা প্রার্থনা! এ জন্য তারা সরকারি দলের প্রতীক ব্যবহার থেকে শুরু করে সরকারের কাছ থেকে নানা সহায়তা পেতে মরিয়া! কাঙ্খিত সুবিধা না পেয়ে অভিমান করার ঘটনাও ঘটেছে। জাতীয় পার্টিও এর বাইরের নয়। কারণ, জাতীয় পার্টিও নিজের শক্তিতে নয়, সরকারি দলের অনুকম্পার আবর্তে ঘুরছে। জাপার বড় শূন্যতা, দলে কোনো রিয়েল পলিসি মেকার কেউই নেই। একটা রাজনৈতিক দল এভাবে টিকে থাকতে পারে না। জাতীয় পার্টির বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে, পরগাছা, উচ্ছিষ্ট, গৃহপালিত যা-ই বলা হোক। জাতীয় পার্টির নাম বদল করে ‘আওয়ামী জাতীয় পার্টি’ বলেই ভালো মানাবে। এরপর ইনু, মেনন আর দীলিপ বড়ুয়ার দলের মতো অবস্থা হবে।
ক্ষমতাসীনদেরও মনে রাখতে হবে, ৭ জানুয়ারি যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন করে ফেললেই রাজনৈতিক সংকট কেটে যাবে বা আপামর জনসাধারণের আস্থা ফিরবে, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান।