ইউরোপীয় ভিসা সেন্টার স্থানান্তরে জোরালো জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন

:: অনিক দে ::
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের প্রধান মাইকেল মিলারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিনিধিদল গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো এত রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি সরকার প্রধানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সাক্ষাৎ করলেন।
এই বৈঠকে, প্রফেসর ইউনূস লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে ইউরোপীয় ভিসা আবেদন সেন্টারগুলোকে নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। একই সাথে তিনি উল্লেখ করেন ভারতের ভিসা বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের ইউরোপীয় ভিসা পেতে বাঁধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ শুধু নিজের স্বার্থে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ভিসা সেন্টার ঢাকায় স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আর শ্রম অভিবাসন এর বাস্তবতায়, ভিসা সেন্টার ঢাকায় স্থানান্তরের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে উভয় পক্ষই উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়।

ভিসা প্রত্যাশীদের আবেদন প্রক্রিয়ার গতি তরান্বিত হবে
ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভিসা প্রত্যাশী বাংলাদেশী নাগরিকদের আবেদন এবং বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নয়াদিল্লি ভ্রমণসহ জটিল সব প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। এতে একদিকে যেমন ভিসা প্রত্যাশীদের খরচ বাড়ে, একইসাথে ভিসা প্রক্রিয়াও দীর্ঘায়িত হয়। তার উপর বর্তমানে, ভারত বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা সীমিতকরণ নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে, ইউরোপীয় ভিসা আবেদনকারীদের ইউরোপ ভ্রমণ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকায় ভিসা সেন্টার স্থানান্তরিত হলে সেটা ভিসা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে সহজ করবে। বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য আর্থিক সাশ্রয় হবে, দূর হবে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা। এই পদক্ষেপটি শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং পর্যটনের মতো উদ্দেশ্যে বৈধ ভ্রমণকে সহজতর করবে। এতে ইইউ এর অন্তর্ভুক্তি আর অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে আর এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ইউরোপ ভ্রমনের সমান সুযোগ পাবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটঃ ইউরোপে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী প্রবাসী
এক-দুই দশক আগেও হাতেগোনা বাংলাদেশি নাগরিক পর্তুগাল, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার মতো দেশে পাড়ি জমাত। যার ফলে, দিল্লির দূতাবাসগুলোতে কনস্যুলার পরিসেবা বজায় রাখা যুক্তিসঙ্গত ও আর্থিক ভাবে যৌক্তিক ছিল।
গত এক দশকে ইউরোপে বাংলাদেশী প্রবাসীর সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও যুক্তরাজ্য কিংবা ইতালির মতো দেশগুলিতে আগে থেকেই বাংলাদেশীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল, বর্তমানে পর্তুগাল, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলো ক্রমেই বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পর্তুগালে বাংলাদেশিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৫০০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি সেখানে বসবাস করছেন। পর্তুগালের মত ফ্রান্সেও বাড়ছে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্যারিসের মতো বড় শহরগুলিতে।
যদিও অস্ট্রিয়া বিগত সময়ে খুব বেশী জনপ্রিয় ছিল না, তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশী অভিবাসীদের অস্ট্রিয়া গমন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও ডাক্তারি পড়ার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠা বুলগেরিয়া যাচ্ছেন। অপ্রচলিত গন্তব্যস্থল্গুলি যেমন- পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র কিংবা লিথুয়ানিয়ায় শিক্ষা অভিবাসনও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গন্তব্যের এই বৈচিত্র্য নিরবিচ্ছিন্ন ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করার দাবি রাখে। ঢাকায় ভিসা সেন্টার স্থানান্তরিত হলে বাংলাদেশী অভিবাসীদের ইউরোপে ভ্রমণ যেমন সহজতর করবে, তেমনি ইউরোপীয় দেশগুলির অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নেও ব্যপক ভূমিকা রাখবে। এবং একইসাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হবে।

উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হবে
সাশ্রয়ী মূল্যের টিউশন ফি, মানসম্পন্ন প্রোগ্রাম এবং অধ্যয়ন-পরবর্তী কাজের সুযোগের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকে ক্রমশই আগ্রহ বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী গন্তব্য ছাড়াও, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে ছাত্র অভিবাসন লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বুলগেরিয়া মেডিকেলের মতো বিষয়ে কম টিউশন ফি এবং বৃত্তি প্রদান করছে। রোমানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজিতে শিক্ষা প্রদান করছে যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে। লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়া তাদের ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিন্যস্ত আবাসিক প্রক্রিয়ার কারণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
শুধুমাত্র ২০২৩ সালে, ৫২০০০ এরও বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যাচ্ছে। ঢাকায় ভিসা সেন্টার স্থাপন করা হলে এই শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা কমবে, তারা আরও সহজে শিক্ষার সুযোগ পেতে সক্ষম হবে। ফলে, বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধি-বৃত্তিক অবদানের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও উপকৃত করবে। সেই সাথে উপকৃত হবে সমাজ ও রাষ্ট্র।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সফট পাওয়ারকে শক্তিশালী করবে
ঢাকায় ভিসা সেন্টার স্থানান্তর করার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলোর শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হবে। এ ধরনের পদক্ষেপকে অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের স্বীকৃতি, সদিচ্ছা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হবে। সেইসাথে ভিসা প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করে, ইউরোপীয় দেশগুলো সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে তাদের লক্ষ্যগুলিকে আরও এগিয়ে নিতে পারে, যার ফলে তার সফট পাওয়ার বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মনে করে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে একটি দূতাবাস খোলা বা একটি আবাসিক কার্যালয় স্থাপনও সংশ্লিষ্ট দেশকে বাংলাদেশের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে সহায়তা করবে।

প্রয়োজন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জোরালো ভূমিকা
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই সক্রিয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে কূটনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করা, ভিসা সেন্টার স্থানান্তরের লজিস্টিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা উপস্থাপন এবং শক্তিশালী বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধার ওপর গুরুত্বারোপ করা। এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাও কমাতে হবে। উল্লেখ্য যে, ক্রমবর্ধমান ডায়াস্পোরা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদা তুলে ধরা বাংলাদেশের লক্ষ্যকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
তদুপরি, প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা এবং সুবিধার রূপরেখা দিতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করতে মন্ত্রণালয়কে ইইউ কর্মকর্তাদের সাথে যৌথ কর্মশালা বা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করা উচিত। ইউরোপে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে সেদেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সাথে কাজ করার মাধ্যমে।
ভিসা সেন্টারগুলিকে নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ যা বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান করে৷ বাংলাদেশের জন্য, এটি লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে, তার নাগরিকদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করবে এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানকে সমুন্নত করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য, এটি তার সফট পাওয়ারকে শক্তিশালী করবে, বাংলাদেশের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং তাদের অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
পরিশেষে, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। এটি করার মাধ্যমে মন্ত্রনালয় কেবল প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে না বরং বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়কে উন্মোচিত করবে, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্বার্থ এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হতে পারে।

লেখক: অনিক দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ হতে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছেন।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের  লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]