মানুষকে বলা হয় “আশরাফুল মাখলুকাত” বা সৃষ্টির সেরা জীব। মহান আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে মনোনীত করেছেন। মানুষের আছে মনুষ্যত্ব, জ্ঞান-বৃদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, এগুলো দিয়ে একজন মানুষ ভালো-মন্দ বিচার করেন। যার মনুষ্যত্ব নাই, সে মানুষরূপী অমানুষ। অমানুষ কখনো ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না। যেমন, বনের জন্তু। আমরা মাঝে মধ্যেই জন্তুর প্রতিচ্ছবি মানুষরূপী অমানুষের আচরণ ও কার্যকলাপে দেখতে পাই।
সম্প্রতি দেশবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আর্শীবাদে জন্তুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাঝে। যা দেখে বিবেকবান মানুষ হতাবাক হয়েছে। যারা মোটেও হতবাক হননি, তারা বিবেকহীন মানুষ। বিবেকহীন মানুষ মৃত মানুষের সমতুল্য।
স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক বরগুনার পাথরঘাটার সন্তান তোফাজ্জল। এলাকায় তিনি অত্যন্ত সজ্জন, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান। চার বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান। গত বছর পনেরো রোজায় লিভার ক্যান্সারে মারা যান বড় ভাই। চোখের সামনে বাবা, মা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। সেই থেকে শুরু হয় তার ভবঘুরে জীবন। তোফাজ্জলকে মাঝে মধ্যে পাথরঘাটা দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় তিনি লাপাত্তা থাকতেন। পাথরঘাটার অনেকে তোফাজ্জলকে উদাম শরীরে, কখনো নোংরা পোষাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুড়াঘুড়ি করতে দেখেছেন। এমন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকহীন কয়েক শিক্ষার্থী।
তোফাজ্জলের অপরাধ তিনি সন্দেহভাজন একজন মোবাইল চোর। আরও অপরাধ পাগল হলেও ফোন নম্বর মনে রাখতে পারা। তার চেয়েও বড় অপরাধ, ক্যান্টিনের খাবারের মান ভালো বলা। মৃত্যুর আগে মানুষের হয়তো খাবারের স্বাদ অমৃত লাগে। এই খাবার জীবনের শেষ খাওয়া হবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। খাবার হজমও করতে পারলেন না, তার আগেই মারধর করে হত্যা করলেন ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র। ইতিহাসের পাতায় ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তোফাজ্জলকে হত্যার কারণে নয়, বরং তাদের উদার মানবিকতায়। তোফাজ্জলকে হত্যার আগে শেষবারের মতো ভাত ও পানি খেতে দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আবরারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এই অপরাধে আবরারকে সাত-আটজন ছাত্রলীগ নেতা শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে দফায় দফায় বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। আবরারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার খবরে ব্যথিত হয় বাংলাদেশের মানুষ।
চব্বিশ বছরের যুবক বিশ্বজিৎ ছিলেন দর্জি দোকানের কর্মচারী। বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মশুরা গ্রাম। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। প্রতিদিনের মত রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে শাঁখারী বাজারের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন বিশ্বজিৎ। তৎকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশ^জিৎ পৌঁছামাত্র একটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। আতঙ্কে অন্যান্য পথচারীদের মত নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়ে পালাচ্ছিলেন বিশ্বজিৎও। কিন্তু রক্ষা পেলেন না। বিরোধী দলের কর্মী সন্দেহে বিশ্বজিৎকে বন্য প্রাণী শিকারের মতো ধাওয়া করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০-১২জন ছাত্রলীগ কর্মী। হত্যাকারীরা রাজপথে, প্রকাশ্য দিবালোকে সাংবাদিক, মানুষ আর ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে ও বেদম প্রহার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ্বজিৎকে হত্যার পর হত্যাকারীরা সেদিন আনন্দ মিছিলও করেছিল। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না। হত্যার নির্দয় দৃশ্য দেখে মানুষ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকা, টেলিভিশনে বিশ্বজিৎ এর হত্যাকারী মানুষরূপী হায়েনাদের ছবি সেদিনও দেশের মানুষ দেখেছিল।
তোফাজ্জল, আবরার ও বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা প্রত্যেকেই দেশের ঐতিহ্যবাহী তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হয়েও তাদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব ছিল না। কেনো মানুষরূপী ওই ছাত্রগুলো অমানুষ হলো। এই প্রশ্ন দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে। এ দায় শুধুই কি হত্যাকারী শিক্ষার্থীদের? সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও হত্যাকারী পরিবারের মা-বাবা কি এ দায় কোনোভাবে এড়াতে পারবেন?
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিশ্বজিৎ হত্যাকারী সাজাপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তারে গাফিলতি, পলাতকদের খুঁজে পেতে ব্যর্থতা, নিম্নমানের তদন্ত ও প্রসিকিউশনের দুর্বলতায় আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে কারো সাজা কমানো হয় এবং কারো খালাস দেওয়া হয়। নিম্নমানের তদন্ত ও প্রসিকিউশনের দুর্বলতায় সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় হত্যাকারীরা বারবার এমন কা- ঘটাতে সাহস পায়। তাই হত্যাকারীদের এ দায়ভার কোনোভাবেই এড়ানোর সুযোগ নেই সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকবান্ধব পরিবেশের পরিবর্তে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক প্রশাসন। ছাত্রদের ডাকসু ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না করা। ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুরবৃত্তি ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি। কতিপয় শিক্ষককের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থে ছাত্রদের উসকানি দিয়ে ভিন্নমতের শিক্ষকদের অসম্মান করানো। ঢাবির প্রশাসনের নাকের ডগায় অনুমতি ছাড়া কত-শত অনুষ্ঠান, গণবিবাহের আয়োজন হলেও রমজান মাসে বটতলায় কোরআন মাহফিল আয়োজনে জড়িত শিক্ষার্থীদের কেনো শাস্তি দেওয়া হবে না মর্মে কলা অনুষদের ডিনকে নোটিশ। প্রশাসন ও কতিপয় শিক্ষকদের অসমতা কার্যক্রমে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কেন্দ্র নয়, পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে মূল্যবোধ তৈরি করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকরাও দায় এড়াতে পারেন না।
ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলেই সব মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো মানুষ হবে এমনটা নাও হতে পারে। সন্তানের প্রথম শিক্ষক মা-বাবা। ভালো-মন্দের পার্থক্য, মানুষের প্রতি সহানুভূতি, ভালোবাসা, মহানুভবতা, বড়দের সম্মান, ছোটোদের স্নেহ করার প্রথম শিক্ষাটাই দিয়ে থাকেন মা-বাবা। জীবনে মেধাবী হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, ভালো মানুষ ও বড় হৃদয় থাকাও গুরুত্বপূর্ণ- সেই শিক্ষাটাও দিবেন মা-বাবা। হত্যাকারীদের মা-বাবা হয়তো সন্তানদের এমন শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ করতে তাদের বিবেক কাজ করে নাই। জন্তুর মতো নিরীহ মানুষ হত্যার এ দায় হত্যাকারী সন্তানের মা-বাবাদের এড়ানোর সুযোগ নাই। মা-বাবাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হলেও বিবেকের কাঠগড়ায় দুই হাত করজোড়ে আমৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেছিলেন। মামলায় আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন দেন আদালত। আবরারের বাবা রায়ে সন্তুষ্ট হলেও দ্রুত রায় কার্যকর চেয়েছিলেন। রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৭ আসামি আপিল করেন। আপিল শুনানির রায়ের দিনক্ষণের অপেক্ষায় রয়েছেন আবরারের বাবা। উচ্চ আদালতে আবরার হত্যার রায় কি হবে জানি না, তবে মনে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যার রায়ে মা কল্পনা রাণীর কথা আজও কানে ভাসে- তাদের ছবি (হত্যাকারীদের) দেশের পত্রিকা, টেলিভিশনে প্রকাশিত হলো। তারপরও তাদের মুত্যুদণ্ড পরিবর্তন করা হলো? তাদের খালাস দিতে হলো? একই কথার পুনরাবৃত্তি করবেন কিনা আবরারের বাবা, ভাবতেই চোখের কোণে জল এসে যায়।
রাজধানীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী প্রীতির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। প্রীতির বাবা মেয়ে হত্যার বিচার চান নাই, তিনি বিচার দিয়েছিলেন আল্লাহর কাছে। আবরার হত্যার রায় কার্যকরের দীর্ঘসূত্রিতা ও বিশ্বজিৎ হত্যার রায়ে হতাশ হয়ে হয়তো তিনি মেয়ে হত্যার বিচার চান নাই। হয়তো প্রীতির বাবার ধারনা বিচার চেয়ে কোনো লাভ নাই, বিচার হলেও ন্যায় বিচার পাবেন না। তোফাজ্জলের আপনজনদের কেউ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে আদৌ কি তারা বিচার চাইতেন?
হত্যাকারীদের প্রোটেকশন দিতে তাদের কুশীলবরা আবরার ও বিশ্বজিৎকে শিবির এবং তোফাজ্জলকে মোবাইল চোর তকমা লাগানোর চেষ্টা করেন। বিশ্বজিৎ তো হত্যাকারীদের বলেছিলেন, “আমাকে মেরো না। আমি শিবির করি না। আমি হিন্দু।” বিশ্বজিৎ হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা কেনো তাকে হত্যা করলো? ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাই বলে ভারত-বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তি নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশে আবরারকে শিবির তকমা দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। শিবির বা চোর হলেই কাউকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করা যায়? পিটিয়ে হত্যা করার সারিটা আর কত বড় হলে তকমা রাজনীতি বন্ধ হবে। তোফাজ্জল-আবরার-বিশ্বজিৎ আমাদের ক্ষমা কর। ওপারে ভালো থাক তোমরা।
লেখক: মো. নবী আলম, লেখক ও সাংবাদিক।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]