ভিন্ন রঙের সবজি চাষ করে লাখপতি তরুণ মিঠুন

:: অমিতা সিনহা ::
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

শূণ্য থেকে লাখপতি হয়ে উঠেছেন সিলেটে গোয়াইনঘাটের বড় নগর গ্রামের বাসিন্দা তরুণ যুবক মিঠুন দে। মাত্র তিন মাসের যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণকে পুঁজি করে মাঠের পর মাঠ রংবেরঙের সবজি চাষাবাদ করে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে।

ত্রিশের মিঠুন শুরুতে বারংবার নানা কারণে ব্যবসায় ঝড়ে পরলেও মনবল কখনো ভেঙে পড়েনি তার। ধার-দেনা করে পুরো দমে চার বিঘা জায়গার উপর দেশীয় সবজির চাষাবাদ শুরু করেন। অন্যের ভূমিতে চাষাবাদের জন্য বছরে ১৫মণ ধান বিনিময় করেন সে। সেখানে টানা দুই বছর কাজ করে সফলতা চূড়াঁয় পৌছে যান। এখন শুধু সবজি চাষাবাদ করে মাসে প্রায় ৪০/৪৫ হাজার টাকা লাভবান করছেন। যা বছরে লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাঠে পর মাঠ জুড়ে সবুজের সবজির বাগান। সেখানে ভেসে উঠে বেগুণী, হলুদ, কমলা, সাদা ও সবুজের মতো ফসল। যা দেখে নজর কাড়ে সর্ব সাধারণ মানুষের। সারি বদ্ধ প্রকার ভেদের সবজির চাষাবাদ। সেখানে সার হিসেবে ব্যবহার করছে জৈব সার। এমন নজর কাড়া বাগানে নানা রঙের ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, তরমুজ, ভুট্টা, কচুসহ আরো হরেক রকমের সবজি রয়েছে।

গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নের বড়নগর গ্রামের বাসিন্দা বাবা রবি চন্দ্র দে(৬০) ও মা গোংগারাণী দে(৫০) ঘরের চার সন্তানের মধ্যে জেষ্ঠ্য সন্তান মিঠুন দে। দুই ভাইবোন চাকুরীজীবী হলেও মিঠুন এইচ এস সি পাস করে ৬টি বিষয়ের উপর যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তিতে প্রশিক্ষকদের পরামর্শে যুব উন্নয়নের তিন মাসের প্রশিক্ষণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

মিঠুন দে বলেন, আজকের আমার চার বিঘার জায়গার উপর সফল ফসল চাষাবাদ করা খুবই কঠিন ছিল শুরুতে। কিন্তু আমার মনের জোর আর ধের্য্য শক্তি কখনো দমেনি। তাই ধীরে ধীরে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় ছিল মানুষ আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না। একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলাম।

মিঠুন বলেন, যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রথমে আমি পোল্ট্রি ফার্ম শুরু করি ২০১১ সালে। তখন ব্যবসা প্রথম দিকে ভালো হলেও দেশে জ্বালাও পোড়াও আর করোনায় ধ্বস পড়ে যায়। এর মধ্যে ২০১৭ সালে দ্বিতীয় বার যখন তরমুজ আর করলা দিয়ে সবজি চাষাবাদ শুরু করি, তখন আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যায় সব তলিয়ে যায়। এরপর আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। সামাজিক দিক ও পারিবারিক দিক দিয়েও।

মিঠুন বলেন, এমনি পরিস্থিতি হয়েছিল যে, কেউ আমার সাথে মিশতো না। আমার খারাপ অবস্থার জন্য আমিও কারো সাথে মেলামেশা করতাম না। এক পর্যায়ে পুনরায় নিজেকে শক্ত করে ২০১৮ সালে বাকিতে সবজির বীজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করি অক্টোবর মাসের দিকে প্রায় ১২০ শতক জায়গার উপর। সেখানে পাতাকপি, ফুলকপি, আলু, ভুট্টা, ধান ফলন করি। তিনি জানান, তখন আমার কোনো পুঁজি ছিলো না। একেবারে শূন্য হাতে শুরু করি। প্রতিদিন নিজে ১৬-১৮ ঘন্টা শ্রম দেয়। সে সময় কোনো ব্যাংকের কোনো ঋণও পায়নি। ওরা দুই বছর না হলে আমাকে লন দেবে না । তাই পর পর বাঁকি নিয়ে সবজি চাষাবাদকে আরো ব্যাপক আকারে ধারণ করতে থাকি। যখন আস্তে আস্তে সফল সবজি চাষাবাদের দুই বছর হলো। তখন যুব উন্নয়ন ও কৃষি ব্যাংক বিভিন্ন সহায়তা পেতে থাকি।

শিক্ষিত এ যুবক আরও জানান, চাষাবাদের জন্য জমি নেই, তাই অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে বছরে ১৫ মণ ধানের বিনিময় করেছি। এখন মোটামুটি একটা পুঁজি করতে পেরেছি। মাসে এই সবজির থেকে সব খরচপাতি বাদ দিয়ে ৪০/৪৫হাজার টাকা লাভ করছি। এখন আমার সবজির মৌসুমে ৩/৪জন কর্মী আছে। মাসে জন প্রতি দেওয়া হয় ৯হাজার বেতনে। আর যারা দিন হিসেবে কাজ করছে তাদেরকে সাড়ে ৪শ’ টাকা করে দিয়ে থাকি। কাজ বাড়লে কখনো ৮/৯জন কর্মী রাখি। সবজি চাষের প্রথম বছর শুধু তরমুজ থেকে প্রায় ৮০হাজার টাকার মতো লাভ করি। এরপর আমি নিজে ৩০হাজার টাকার মতো ইনভেস্ট করেছি। যখন সবজির মৌসুম শেষ, তখন আমি ধান চাষাবাধ করে থাকি। সে বছর আমি টাকার অভাবে কোনো কর্মী রাখিনি। একা হাতে নিজের শ্রম দিয়ে সে বছর চাষাবাদ করেছিলাম। সেই সময় আমি ইউটিউবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রঙবেরঙের সবজির চাষাবাদ দেখেছি। মনে মনে ভাবলাম নতুন কিছু করি। সবাই যা ভাবে সেই চিন্তা থেকে বের হয়ে আস্তে হবে। তখন আমার পরিবার আমাকে আর্থিকভাবে সহযোগীতা করেছিল। পাশাপশি কিছুটা ব্যাংক থেকে পরামর্শ ও ঋণও নিয়েছিলাম। এর পরের বছর আমি চার রঙের ফুলকপি দিয়ে সবজির চাষাবাদ শুরু করি সাদা, ব্রকলি, হলুদ ও বেগুণী দিয়ে। মোটামুটি লাভও হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৩লাখের মতো।

তিনি আরও বলেন, এবছর ছয় কালারের ফুলকপি, বাধাকপি, তরমুজ, আলু ও ভুট্টা দিয়ে সবজি চাষাবাদ শুরু করেছি। এবছরের সবজি চাষাবাদ থেকে কত লাভ হবে সেটা নির্ভর করবে বাজারের দাম ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। আশা করছি, যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসে, তবে গত বছরের তুলনায় দুই গুণ, তিন গুণের উপর লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সামনের বছর আরো ব্যাপক আকারে সবজির চাষাবাদের পরিকল্পনা আছে আমার।

এ প্রসঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন বলেন, তরুণ মিঠুনের সবজির চাষাবাদ দেখে অনেক মানুষ উপকৃত হচ্ছে। ওকে দেখে অনেকেই সবজি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করছে। তার এই চেষ্টা সবাইকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে এবং হরেক রকমের রঙিন সবজি বাগান দেখতে দুরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ ছুটে আসছে।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]