মেহজাবিন বানু:
বাংলাদেশ ২০২২ সালে বেশ কয়েকটি মেগা পরিবহন ও যোগাযোগ প্রকল্পের সমাপ্তি দেখেছে, যা এই খাতের উন্নয়নে একটি বিপ্লব চিহ্নিত করেছে।
২০২২ সালে বাংলাদেশে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বিপ্লব ঘটেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয় চলতি বছরের ২৫ জুন। এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর। এ ছাড়া সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ২০২২ সালে ১০০ কিলোমিটারের ১০০টি সেতু ও ১০০টি সড়ক একসঙ্গে চালু করা হয়। এছাড়া কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-কক্সবাজার রেলওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পসহ বর্তমান সরকারের অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া বাস রুট জাতীয়করণ কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। এই কমিটি গত বছর আরও দুটি রুটে ঢাকা মহানগর পরিবহনের বাস সার্ভিস চালু করে। ঢাকা মহানগর পরিবহনের বাস চলছে তিনটি রুটে। তাই পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মেগা প্রকল্প সম্পন্ন হলে এবং গণপরিবহন ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে আনতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পদ্মা সেতু
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা রুটে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মিত হয়। চলতি বছরের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এই সেতুটি উদ্বোধনের ফলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার মানুষের যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। আগে বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে ৫-৮ ঘণ্টা লাগতো। বরিশালের যাত্রীরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাতে পারছেন তারা।
মেট্রোরেল
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬-এর ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশটি ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল সার্ভিসের উদ্বোধন করেন। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর দৈর্ঘ্য ২১.১৬ কিলোমিটার। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর ৮৪.২২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের এলাকার যানজট নিরসনে ওভারপাস ও সাবওয়ের সমন্বয়ে মেট্রোরেলের ছয়টি লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো রেলপথ হবে ১২৮.৭৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৭.৫৬৯ কিমি ওভারগ্রাউন্ড এবং ৬১.১৭২ কিমি মাটির নিচে থাকবে। মেট্রোরেলের এই ছয় লাইনের নির্মাণ কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলো সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বাস্তবায়ন করছে।
বঙ্গবন্ধু টানেল
আনোয়ারাকে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘এক শহর-দুই শহর’ মডেলে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল। চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) চলমান চীনা অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা এবং পূর্ব প্রান্তে আনোয়ারা এলাকাকে সংযুক্ত করেছে। টানেলে দুটি টিউব রয়েছে। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করবে দক্ষিণ পাশের নল দিয়ে। এই টিউবের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা যাতায়াত হবে উত্তর দিকের নল দিয়ে। এই নলটির সার্বিক নির্মাণ অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। আর পুরো প্রকল্পের ৯৪ শতাংশ কাজ এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
উত্তরা বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উরাল রোড) নির্মাণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত উদল সড়ক প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তিন ভাগে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ চলছে। সেতু কর্তৃপক্ষ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সৈয়দাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)
গাজীপুরের শিববাড়ি থেকে উত্তরা বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চ-গতির পৃথক বাস লেন বা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি-৩) প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিবিআরটিসিএল)। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ২৫ শতাংশ। নয় বছরে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে তিন গুণ এবং সময়কাল চার গুণ। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে।
পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্প
৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গত জুলাই পর্যন্ত ৬৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল সংযোগের প্রায় ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা-ভাঙ্গা থেকে প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে। প্রকল্পের পুরো কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলওয়ে
ট্রান্স এশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল রেলওয়ে রুটের অংশ হিসেবে ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমঘুম রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা 3 এপ্রিল, 2011-এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৭ এপ্রিল ২০১৬-এ, প্রকল্পটি একটি দ্রুত ট্র্যাক প্রকল্প হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। মায়ানমার সীমান্তের কাছে ঘূম ঝুম পর্যন্ত একটি ২৮.৭৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের আগ্রহ না থাকায় দ্বিতীয় অংশের কাজ এখনো শুরু হয়নি বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৭ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের জুন মাসে রেলপথ চালু হবে।
মূললেখা: myrepublica.nagariknetwork.com/news/bangladesh-s-progress-in-transport-and-communications-in-2022
নেপালের প্রভাবশালী ‘মাই রিপাবলিকা’, আন্তর্জাতিক নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে অংশীদারিত্বে নেপালের একমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত সংবাদপত্র, সার্কুলেশন: ১৫২০০০, থেকে অনুবাদ করা।
লেখিকা: কলামিস্ট, উন্নয়ন ও স্থানীয় সমাজকর্মী।