২০২২ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে কিছু কথা

::
প্রকাশ: ২ years ago

পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক: 
এ বছরের নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখক অ্যানি আর্নাক্স। তিনি কয়েক দশক ধরে তার অতীতের অপমানজনক, ব্যক্তিগত এবং মর্মপীড়াদায়ক মুহূর্তগুলো বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তুলে করেছেন। তিনি ১৯৭৭ সালের স্মৃতিকথা ‘সেইম’-এ লিখেছেন, ‘আমি আমার নিজের একটি জাতিতাত্ত্বিক পর্যালোচনা সম্পন্ন করব।’

গত ৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার তার কাজের জন্য সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তার লেখা নারী এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবন থেকে উঠে এসেছে। যা সাহিত্যে খুব কমই স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি নরম্যান্ডির একটি ছোট শহরে বেড়ে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৬০ এর দশকে তার একটি অবৈধ গর্ভপাত হয়েছিল। গার্হস্থ্য জীবনের সাথে তার অসন্তোষ এবং একটি আবেগপূর্ণ বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কের কথা অকপটে বলেছেন।

এবছর একজন লেখককে সম্মান জানানোর জন্য এটি ছিল চমক জাগানো মনোনয়ন। তার কাজগুলো একান্তভাবে ব্যক্তিগত। অনেকটা সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস মালম স্টকহোমে একটি সংবাদ সম্মেলনে পুরস্কারের এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। তিনি প্রশংসা করে বলেন, ‘তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছেদ ও সমষ্টিগত বাধার কথা সাহস এবং বস্তুনিষ্ঠ উপলব্ধির মাধ্যমে তীক্ষ্মতার সাথে উন্মোচন করেছেন।’ প্যারিসে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশক গ্যালিমার্ড এবং ৮২ বছরের আরনাক্স লেখা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার জন্য নোবেল পুরস্কার হলো লেখা চালিয়ে যাওয়ার একটি অনুপ্রেরণা।’

বিশেষ করে, নারীরা যে বৈষম্য এবং সংগ্রামের মুখোমুখি হন; তার পরীক্ষা চালিয়ে যেতে তিনি বাধ্য। তিনি আরও বলেন, ‘আমার অবস্থান থেকে একজন নারী হিসেবে কথা বলতে গেলে মনে হয় না যে, আমরা স্বাধীনতার বেলায় সমান হয়েছি।’

১৯০১ সালে নোবেল কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকে ১১৯ জন লেখককে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। যার মধ্যে অ্যানি আর্নাক্স হলেন ১৭তম নারী। ২০২০ সালে আমেরিকান কবি লুইজ গ্লুককে এ সম্মান দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় নারী, যিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।

আর্নাক্স তার কর্মজীবনের প্রথমদিকে আত্মজীবনীমূলক কথাসাহিত্য লিখেছিলেন। তিনি গতানুগতিক ধারণা পরিত্যাগ করে একটি প্লট উদ্ভাবন করে স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেছিলেন। যদিও তিনি তার কাজকে কল্পকাহিনি বা নন-ফিকশন হিসেবে চিহ্নিত করার বিরোধিতা করেছেন।

সেভেন স্টোরিজ প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ড্যান সাইমন বলেছেন, ‘তিনি যা কিছু লিখেছেন, প্রতিটি শব্দ আক্ষরিক ও বাস্তবিকভাবে সত্য। যা ৩১ বছর ধরে ইংরেজিতে প্রকাশ করছেন। তবুও এগুলো অসাধারণ কাজ।’

১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তিনি অবাঞ্চিত গর্ভাবস্থা, গর্ভপাত, প্রেম, বিবাহ এবং মাতৃত্ব সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। যা সামাজিক রক্ষণশীলদের দ্বারা ঘৃণিত কাজ বলে বিবেচিত হয়েছিল। তবে সেগুলো বিস্তৃত পাঠকদের গভীরভাবে অনুরণিত করেছিল।

আর্নাক্স তার লেখাকে রাজনৈতিক ক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যার অর্থ পরিখা খনন করে সামাজিক বৈষম্য প্রকাশ করা। তার ভাষার ব্যবহারকে ‘ছুরি’র সাথে তুলনা করেছেন। তিনি সিমোন ডি বেভিয়ার, সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বোর্দিউ এবং ১৯৬৮ সালের মে মাসের সামাজিক অভ্যুত্থান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যখন ফ্রান্সে কয়েক সপ্তাহ বিক্ষোভ, ধর্মঘট এবং নাগরিক অস্থিরতা ছিল। তিনি তার গদ্যকে ‘সরাসরি নিষ্ঠুরতা, শ্রমজীবী এবং কখনও কখনও অশ্লীল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আর্নাক্স প্রায়ই ফরাসি সংস্কৃতি ও সমাজের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-স্মৃতিগুলো চিত্রিত করেন। তার জীবন, নারী ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সর্বজনীন সংগ্রামের মধ্যে সমান্তরাল রেখা আঁকতেন। আর্নাক্সের কাজগুলো ফ্রান্সের প্রথাগত ক্যাথলিক মূল্যবোধ থেকে দূরে, আরও ধর্মনিরপেক্ষ, অনুমতিমূলক ও যৌন মুক্ততার দিকে প্রবল সামাজিক পরিবর্তনের একটি মুহূর্তকে বন্দি করে।

‘যখন তিনি শুরু করেছিলেন, তখন এটি প্রতিষ্ঠার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। যেভাবে নিজেকে এবং তার জীবনকে ফ্রান্সের সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে বড় প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলেন।’ বলেছেন ঔপন্যাসিক হ্যারি কুনজরু। যিনি প্রায়ই নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্রদের আর্নাক্সের কাজ শেখান। ‘সাহিত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রান্সের উত্তরের একজন শ্রমিক শ্রেণির নারীর এটি করার কথা নয়। তবুও তিনি নিজেকে খুব শক্তিশালী বিকল্প করে তোলেন। তিনি স্বতন্ত্রভাবে একটি সাধারণ উপায়ে কথা বলতে চান।’

আর্নাক্স ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। নরমেন্ডির একটি ছোট শহর ইভেটটে শ্রমজীবী-শ্রেণির ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। যেখানে তার বাবা-মায়ের একটি মুদি দোকান এবং ক্যাফে ছিল। তার বাবা ছিলেন হিংস্র ও কটূভাষি। মাত্র ১২ বছর বয়সে, তার মাকে হত্যাচেষ্টা করতে দেখেছিলেন বাবাকে। এটি এমন একটি ঘটনা, যা তিনি ‘সেইম’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘আমার বাবা জুনের এক রবিবার ভোরবেলা আমার মাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন।’

আর্নাক্স ২০২০ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, তিনি কলেজে থাকতে লেখা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশকরা তার বইটিকে ‘খুব উচ্চাভিলাষী’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর তার বয়স ত্রিশ না হওয়া পর্যন্ত আর লেখালেখি করেননি। তখন তিনি ফ্রান্সের শিক্ষক, বিবাহিত এবং দুই সন্তানের মা।

১৯৭৪ সালে ‘ক্লিনড আউট’ নামে একটি গভীর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখার সময় স্বামীর কাছে গোপন রেখেছিলেন। তিনি প্রকাশনা সংস্থা গ্যালিমার্ডের কাছে বইটি বিক্রি করার পর স্বামী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কেননা তিনি পিএইচডিতে থিসিস করার ভান করে কাজটি গোপন করেছিলেন। ১৯৮১ সালে তৃতীয় বই ‘এ ফ্রোজেন ওমেন’ প্রকাশের পর বিবাহ এবং মাতৃত্ব নিয়ে তার অস্বস্তি ফুটে ওঠে। ফলে বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনি আর বিয়ে করেননি। বলেছিলেন, তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন।

আর্নাক্স ১৯৯২ সালে ‘সিম্পল প্যাশন’ প্রকাশ করে ফ্রান্সে ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য পান। এতে একজন বিবাহিত বিদেশি কূটনীতিকের সাথে তার সম্পর্কের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ফলে রক্ষণশীল নারীরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল। এটিকে যৌন আকাঙ্ক্ষার অকপট চিত্রায়ন বলে মনে করা হয়েছিল। তবে বইটি প্রথম দুই মাসে ২ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে।

আর্নাক্স প্রায়ই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার জীবনের একই ঘটনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা ‘হ্যাপেনিং’ বইতে ১৯৬৩ সালে কলেজ ছাত্রী থাকাকালে তার গর্ভপাতের বিবরণ রয়েছে। যা তিনি প্রথম ‘ক্লিন আউট’ বইতে আভাস দিয়েছিলেন। ‘সিম্পল প্যাশন’-এ কূটনীতিকের সাথে তার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পর সেই সম্পর্কের একটি অবিচ্ছিন্ন আভাস দিয়েছিলেন। তখন তিনি ‘গেটিং লস্ট’ শিরোনামে একটি ডায়েরি প্রকাশ করেছিলেন। যার মধ্যে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ সালের স্মৃতিগুলো লিপিবদ্ধ ছিল। টাইমসের সমালোচক ডোয়াইট গার্নার বইটির পর্যালোচনায় লিখেছেন, ‘তার কণ্ঠ আদিম প্রত্যক্ষতার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। তিনি যেন একটি ছুরি দিয়ে টেবিলের ওপর প্রতিটি বাক্য খোদাই করছেন।’

তার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর একটি বিষয়ে লিখতে তার কয়েক দশক সময় লেগেছিল। ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে তার একটি অপ্রীতিকর যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যখন তিনি ১৮ বছর বয়সী ছিলেন। যা তাকে নেতিবাচক অনুভূতি দিয়েছে। এর ফলে তার মধ্যে হতাশা ও খাদ্যে অরুচি দেখা দেয়।

সমালোচক ও সহযোগী লেখকরা তার কাজের প্রশংসা করেছেন। কারণ তিনি এমনভাবে ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সম্মিলিত অভিজ্ঞতার সাথে সংযুক্ত করেছেন, বিশেষ করে নারী ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য। সাহিত্য কেমন হতে পারে সে ধারণাকেও আর্নাক্স উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন দ্য এন্ড অব এডি গ্রন্থের ফরাসি লেখক এডওয়ার্ড লুই।

যদিও আর্নাক্স দীর্ঘকাল ধরে ফ্রান্সে পঠিত হয়েছেন। কয়েক দশক ধরে ব্যাপকভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। তার স্মৃতিকথা ‘দ্য ইয়ারস’ ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ইংরেজি-ভাষি বিশ্বে খুব বেশি পরিচিতি পাননি।

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসন বৃহস্পতিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘নারী বিজয়ীদের সংখ্যা কম, তবে আমাদের ফোকাস সর্বপ্রথম সাহিত্যের মানের দিকে হওয়া উচিত।’