সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুগে যুগে একত্ববাদের প্রচারে সত্য ও রিসালতের বাণী নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন অগনিত নবী ও রাসুল। জগতের মহান রব, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত প্রতিনিধি বা খলীফা হয়ে বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য এসেছেন আমার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
একজন ঈমানদারের জন্য যেমনিভাবে আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয, তেমনিভাবে তাঁর প্রিয় রাসূল দোজাহানের সরদার বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, শাফিউল মুজনিবীন রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমানের সহিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আনুগত্য করা সমভাবে আবশ্যক। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের ঈমানের মূলে থাকতে হবে হুব্বে রাসুল বা নবী প্রেম। কারণ নবী প্রেম না থাকলে মুমিন হওয়া যায়না।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলেন,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই। (মুসলিম১/১৬হাঃ৪৪,আহমদ১২৮১৪)
আমাদের অনেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অতি সাধারণভাবে বলেদেন যে তিনি আমাদের মতই। আয়াত قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ বলুন, আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় (সূরা কাহাফ-১১০)।
আসলেই কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই! হতে পারে সেটি শারীরিক ভাবে দেখতে।শুধু এতটুকু মিল রয়েছে যে,তিনিও সাধারণ মানুষের মতই পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপন করেছেন।তারমানে এই নয় যে তিনি আমাদের মত সাধারণ।মূলত মানুষ গোনাহ করে কিন্তু আমাদের পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই গোনাহ করেননি। করারতো কোন প্রশ্নই উঠেনা,সৃষ্টির মাঝে সবচে,সেরা নবী তিনি ত্রুটিমুক্ত নিষ্পাপ ছিলেন।মানবিক কোন দুর্বলতাও ছিল না।
মানুষের মাঝে যেসব দোষণীয় বিষয় আছে এমন কোন দোষের আঁচড়নও ছিল না আমাদের পেয়ারা নবীর মাঝে। অনেক পার্থক্য আছে আমাদের ও আমাদের পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাঝে। মানবজাতীর কাছে রিসালাতের অমিও বাণী প্রচারে মানবীয় গুনাবলী থাকতেই হবে।আরবের কাফেররা যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিভিন্ন মুজেজা দেখলেন তখন অনেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভয় পেতে লাগলেন।
কেউ কেউ মনে করে তিনি হয়তো জাদুকর। ফলে ইসলাম প্রচারের যে মহান দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রেরিত হন তার পরিপুর্ণতায় তাদেরকে অর্থাৎ তত্কালীন কাফেরদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংস্পর্শে আসা চাই চাই।অন্যথায় তাদেরকে কিভাবে ইসলামের দাওয়াত দিবেন? তাই তিনি বলেছিলেন,আমি তোমাদের মত,কিন্তু আমার কাছে ওহী আসে। এই (يُوحَى) ওহী’ই যা সাধারণ আর অসাধারণ এর মাঝে অনেক বড় পার্থক্য করে দিয়েছেন।
তাছাড়া আয়াতের প্রথমে আল্লাহপাক তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দিয়ে বলেছেন রাসুল (قُلْ)’কুল’ আপনি বলুন,না বললে যে তারা আপনার কাছে আসবেনা।তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমি তোমাদের মত’ বলাতে সাধারণ মানুষ যারা ভয়পেত তারা অতি সহজে দয়াল নবীর দর্শনে এসে ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নিতে লাগলো।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ ছিলেন তবে আমাদের মত সাধারণ নয়। সৃষ্টির রহস্য কেবল স্রষ্টাই ভালো অবগত এসব নিয়ে তর্কের প্রয়োজন নেই। তবে এটুকু জেনে রাখুন সৃষ্টির মূল উৎস রসুলে পাক সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত জগতের প্রতিপালক আর আমার পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমস্ত জগতে রহমাতুল্লিল আলামীন হিসেবে।
প্রিয়তম বন্ধুকে সৃষ্টি জগতের রহমত হিসেবে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
হে মুহাম্মদ !আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি। (আম্বিয়া-১০৭)
সৃষ্টি জগতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে মর্যাদা প্রদান করে আরো বলেন- وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
অর্থাৎ:এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি। (সূরা আল ইনশিরাহ ৪)
আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি জগতে সাক্ষী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا
হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। (সূরা আহযাব-৪৫-৪৬)
অত্র আয়াতে شَاهِدًا শব্দটি নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন যে, কেও যদি প্রশ্ন করে সাক্ষী কি না দেখে দেওয়া যায়? উত্তর একটাই আসবে না।মিথ্যা- সাক্ষী হতে পারেনা।এখন আসুন আল্লাহ তায়ালা বলেন হে নবী আমি আপনাকে সাক্ষী হিসেবে প্রেরণ করেছি।প্রশ্ন জাগে কীসের সাক্ষী ? শুধু কি ১৪০০ বছর আগের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই ৬৩ বছর হায়াতের সাক্ষী নাকি সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কিছুর সাক্ষী।নিশ্চয় সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কিছুর সাক্ষী।
তাছাড়া أَرْسَلْنَاكَ আপনাকে প্রেরণ করেছি মানে দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছু দেখিয়ে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির গুপন রহস্য অবলোকনকারী কেবল আপনি।
সূরা আন্ আম ১৬২-১৬৩
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلْ اِنَّ صَلٰوتِیْ وَنُسُکِیْ وَمَحْیَاءِیْ وَمَمَاتِیْ لِلّٰہِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ لَاشَرِیْکَ لَہٗ وَبِذَالِکَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ
অর্থাৎ হে নবী! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামায, হজ্ব, কোরবানী, আমার জীবন ও ওফাত বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই, যার কোন শরীক নেই এবং এ বিষয়ে আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান (আল্লাহর দরবারে আত্মনিবেদনকারী)।
অত্র আয়াতে اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ দ্বারা স্পষ্ট যে আল্লাহর নবী সল্লালাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম সৃষ্টির প্রথমে সৃষ্টি।আল্লাহপাকের ওয়াহদানীয়তের অর্থাৎ একত্ববাদের দলিল হচ্ছেন আমার নবী সল্লালাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম।আদম আলাইহি ওয়াছাল্লাম থেকে সমস্ত নবীদের সৃষ্টির পূর্বেই আমার নবীর সৃষ্টি। যদি তা নাই হয় তবে,আমিই প্রথম মুসলমান’ বলার কারণ কী।কাজেই সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণকারী হলেন হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।এ রহস্য কেবল স্রষ্টাই ভালো অবগত এসব নিয়ে তর্কের প্রয়োজন নেই।আসলে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুণাবলীর বর্ণনা,বৈশিষ্ট্য এবং প্রশংসা কারো কলমই সুবিচার করতে পারবেন না।একমাত্র আল্লাহর দ্বারাই শেষ হতে পারে,মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়।
এবার আসুন,রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য যা আমাদের মত সাধারণ নয়।
হযরত আবদূল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে এ হাদীস শোনান হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,বসে কারো সালাত অর্ধেক সালাত। আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি তখন তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে বসে সালাত আদায় করতে পেলাম। তখন তার মাথায় হাত রাখলাম।
তিনি বললেন, হে আবদুল্লাহ ইবনু আমর ! কি ব্যাপার?
আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে হাদীস শোনানো হয়েছে যে, আপনি বলেছেন যে, উপবিষ্ট অবস্হায় কারও সালাত আদায় করা সালাতের অর্ধেকের সমান।অথচ আপনি বসে সালাত আদায় করছেন? তিনি বললেন, হাঁ (আমি তাই বলেছি)
কিন্তু আমি-তো-তোমাদের-কারো-মত-নই। (সহীহ মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটানা সাওম (রোজা)পালন করতে থাকলে লোকেরাও একটানা সাওম পালন করতে শুরু করে। এ কাজ তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়াল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের নিষেধ করলেন। তাঁরা বলল,-আপনি যে এক নাগাড়ে সাওম পালন করেছেন? তিনি বললেনঃ- আমি-তো-তোমাদের-মত-নই। আমাকে খাওয়ানও হয় ও পান করানো হয়। (সহীহ বুখারী)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘ্রাণ মুবারক তাও আমাদের মত সাধারণ নয়।
হযরত মুহাম্মদ (রহঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নফল সাওম (রোজা) র ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,যে কোন মাসে আমি তাঁকে সাওম পালনরত অবস্থায় দেখতে চেয়েছি,তাঁকে সে অবস্থায় দেখেছি,আবার তাঁকে সাওম পালন না করা অবস্থায় দেখতে চাইলে তাও দেখতে পেয়েছি।
রাতে যদি তাঁকে সালাত (নামায) আদায়রত অবস্থায় দেখতে চেয়েছি,তা প্রত্যক্ষ করেছি।আবার ঘুমন্ত দেখতে চাইলে তাও দেখতে পেয়েছি।আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাত মুবারক হতে নরম কোন পশমী বা রেশমী কাপড় স্পর্শ করি নাই।আর আমি তাঁর (শরীরের) ঘ্রাণ হতে অধিক সুগন্ধযুক্ত কোন মিশক বা আম্বর পাইনি। (সহীহ বুখারী)
সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদীহি!
পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং অগনিত সহিহ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমানিত মিরাজ শরিফ যদি সত্যি হয় তাইলে নবী কে আমাদের মত বলাটা বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে! জিব্রাইল (আ:) দ্বারা জমজমের পানি দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্ষ পরিস্কার করাটাও কখনো সাধারণ হতে পারেনা।এই অসাধারণ বক্ষ পরিস্কার অনেকবার করা হয়েছে যা মানবীয় দৃষ্টিতে আদৌ সম্ভব নয়।
হে আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই সব নবী প্রেমিকদের দলে পরিনত করো,যারা হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত নবী প্রেমে সিক্ত হয়ে তোমার হাবিবকে ভালোবাসতে পারে।এবং তোমার আর তোমার হাবিবের হুকুম মেনে এই ক্ষনস্থায়ী জীবনকে পরিচালনা করতে পারি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাদের সকলকে সেই তাওফিক দান করুন, আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট।