হজ ও ওমরাহ পালনকালে মক্কা ও মদিনায় অবস্থান করতে হয়। এখানে কাটানো সময়গুলো সবার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে। স্থান ও সময়ের বিবেচনায় দোয়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। তাই এসব স্থানে দোয়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
কোরআন ও হাদিসে বেশি পরিমাণ দোয়া করতে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা আমার ইবাদতের ব্যাপারে অহংকার করবে তারা অপদস্থ হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৬০) ইহরামের কাপড় পরার পর হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা আল্লাহর ঘরের অতিথি।
আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথের যোদ্ধা, হজ ও ওমরাহ পালনকারী আল্লাহর অতিথি। আল্লাহ তাদের ডেকেছেন এবং তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাই তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি তাদের তা প্রদান করেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৯৩)
নিম্নে হজের যেসব স্থানে দোয়া কবুল হয় তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
কাবাঘরের ভেতরে দোয়া: পবিত্র কাবাঘরের ভেতরে দোয়া করলে তা কবুল হয়। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) কাবাঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দোয়া করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বাইতুল্লাহর ভেতরে প্রবেশ করে এর সব দিকে দোয়া করেছেন। তিনি এর ভেতরে নামাজ পড়েননি।
বের হয়ে কাবাঘরের প্রবেশপথে নামাজ পড়েছেন। এবং তিনি বলেছেন, ‘এটি তোমাদের কিবলা।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩৩১)
সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দোয়া : জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে রাসুল (সা.)-এর হজের বিবরণ দিতে গিয়ে এখানে দোয়া করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) সাফা পর্বত দিয়ে সায়ি শুরু করেন। তাতে আরোহণ করে কিবলামুখী হন। আল্লাহর তাওহিদ ও তাকবির পাঠ করেন এবং আল্লাহর গুণকীর্তন করেন। অতঃপর মধ্যখানে তিনি দোয়া করেন। তিনি এমনটি তিনবার করেন। অতঃপর তিনি নেমে মারওয়া পাহাড়ের দিকে গেলেন। তিনি উপত্যকার সমতল ভূমিতে নেমে সায়ি তথা দ্রুত চললেন। মারওয়া পাহাড়ে হেঁটে উঠলেন। অতঃপর এখানেও সাফা পাহাড়ে যা করেছিলেন তাই করলেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১২১৮)
আরাফার দিনের দোয়া : আরাফার দিনের বিশেষ মর্যাদার কথা হাদিসে এসেছে। এই দিনের দোয়া কবুল করা হয় এবং অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ আরাফায় অবস্থানরত ব্যক্তিদের নিয়ে গর্ববোধ করেন এবং ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা আমার বান্দাদের দেখো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে আমার কাছে উষ্কখুষ্ক ধুলায় ধূসর হয়ে এসেছে। আমি তোমাদের সাক্ষ্য রাখছি, আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া, হাদিস : ৩/৩৪৯)
রাসুল (সা.) আরাফায় অবস্থানকালে কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করেছেন। উসামা বিন জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি আরাফা প্রাঙ্গণে রাসুল (সা.)-এর পেছনে বসেছিলাম। তিনি দুই হাত তুলে অবিরত দোয়া করছিলেন। এ সময় তাঁর উট তাকে নিয়ে একদিকে ঢলে পড়ে এবং উটের লাগাম পড়ে যায়। তখন তিনি এক হাত দিয়ে লাগাম আঁকড়ে ধরলেন। আর অন্য হাত (দোয়ার জন্য) ওপরে ধরে রেখেছিলেন।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩০১১)
এই দিনের দোয়াকে সর্বোত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম দোয়া আরাফা দিবসের দোয়া। আমি ও আগের নবীদের পঠিত সর্বোত্তম দোয়া হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কদির।’ (তিরমিজি, ৩৫৮৫)
মাশআরুল হারামে অবস্থানকালে দোয়া : উল্লিখিত দীর্ঘ হাদিসে ১০ জিলহজ মাশআরুল হারামে পৌঁছার পর রাসুল (সা.)-এর দোয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি কাসওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহণ করে মাশআরুল হারাম নামক স্থানে আসেন। এখানে তিনি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এ সময় তিনি তাকবির, তাহলিল ও তাওহিদ পড়তে থাকেন। দিনের আলো উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবে দোয়া করেছিলেন। সূর্যোদয়ের আগ মুহূর্তে তিনি ফজল ইবনে আব্বাস (রা.)-কে তাঁর সওয়ারির পেছনে বসিয়ে পুনরায় রওয়া করেন…।’ (মুসলিম, হাদিস : ১২১৮)
জামারায় পাথর নিক্ষেপকালে দোয়া : জামারায় পাথর নিক্ষেপের পর দোয়া করা সুন্নত। ইবনে উমর (রা.) কাছের জামরায় সাতটি কঙ্কর মারতেন এবং প্রতিবার কঙ্কর নিক্ষেপের পর তাকবির বলতেন। এরপর সামনে এগিয়ে সমতল ভূমিতে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে উভয় হাত তুলে দোয়া করতেন। অতঃপর মধ্যবর্তী জামরায় আগের মতো কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। এরপর বাঁ দিক হয়ে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতেন এবং উভয় হাত তুলে দোয়া করতেন। জামারা আকাবার কাছে তিনি বেশি করতেন না। তিনি বলতেন, রাসুল (সা.)-কে আমি এভাবে করতে দেখেছি। (বুখারি, হাদিস : ১৭৫২)
জমজমের পানি পানকালে দোয়া : জমজম কূপের পানিতে বিশেষ বরকত রয়েছে। তা যে উদ্দেশে পান করা হয় তা পূর্ণ হয়। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘জমজমের পানি যে উপকার লাভের আশায় পান করা হবে তা অর্জিত হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০১৮)
জমজম পানি খাবারের পরিপূরক। আবু জর (রা.) মক্কায় এসে দীর্ঘ এক মাস অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি জমজম পানি ছাড়া আর কোনো খাবার গ্রহণের সুযোগ পাননি। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতপূর্ণ। তা তৃপ্তিকর খাদ্য এবং রোগ নিরাময়ের ওষুধ।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯২২)
কাবাঘর দেখার দোয়া : রাসুল (সা.) কাবাঘর দেখলে একটি দোয়া পড়তেন। মাকহুল (রহ.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) যখন কাবাঘর দেখতেন তখন তিনি উভয় হাত তুলে বলতেন, আল্লাহুম্মা জিদ হাজাল বাইতা তাশরিফান ওয়া তাজিমান ওয়া তাকরিমান ওয়া মাহাবাতান, ওয়া জিদ মান শাররাফাহু ওয়া কাররামাহু মিম্মান হাজ্জাহু ওয়াতামারাহু তাশরিফান ওয়া তাজিমান ওয়া তাকরিমান ওয়া বিররা। (তাবাকাতু ইবনে সাআদ, ১৭৩/২; আখবারু মক্কা, ৩২৫)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন আমাদেরকে উপরোক্ত আলোচনার প্রতি আমল করার তাওফিক দান করেন, আমীন।
লেখক: হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী; বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট।