নবী-রাসুলদের মধ্যে ইবরাহিম (আ.) অন্যতম। তাঁকে বলা হয় আবুল আম্বিয়া তথা নবীদের আদি পিতা। সাতজন নবী ছাড়া সব নবী-রাসুল তাঁর বংশ থেকে এসেছেন। তিনি মুসলমানদের জাতির পিতা।
মুসলিম নামটি তিনি প্রথম রাখেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রশংসায় বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ইবরাহিম ছিলেন সব গুণের সমাবেশকারী, সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর অনুগত এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। আল্লাহ তাঁকে মনোনীত করেছিলেন এবং পরিচালিত করেছিলেন সরল পথে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২০-১২১)
কাবাঘর নির্মাণ করার পর আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে নির্দেশ দেন যে মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে বায়তুল্লার হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি হজের আজান দেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘আল্লাহ বলেন, ‘এবং স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কোনো শরিক স্থির কোরো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য, যারা তাওয়াফ করে এবং যারা নামাজে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে, তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে ও ক্ষীণকায় উটের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। যাতে তারা তাদের কল্যাণকর স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৬-২৮)
ইবনে আবি হাতেম ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, যখন ইবরাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করেন, এখানে তো জনমানবশূন্য মরু প্রান্তর। ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই, যেখানে জনবসতি আছে, সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। মানুষের কানে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) আবু কুবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বাঁয়ে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে চিৎকার করে ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষেরা! আল্লাহ তোমাদের এ ঘরের হজ করার নির্দেশ করেছেন, যাতে তোমাদের জান্নাত দিতে পারেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে পারেন। সুতরাং তোমরা হজ করো।
এই ঘোষণার পর পৃথিবীর পাহাড়গুলো অবনত হয়ে যায় এবং তাঁর আওয়াজ পৌঁছে যায় পৃথিবীর দিক-দিগন্তে। ইবরাহিম (আ.)-এর এ আওয়াজ আল্লাহ তাআলা সব মানুষের কানে পৌঁছে দেন। এমনকি যারা ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আসবে, তাদের কানে পর্যন্ত এ আওয়াজ পৌঁছে দেওয়া হয়। যাদের ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এ আওয়াজের জবাবে আমি হাজির, আমি হাজির বলে হাজির হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইবরাহিম (আ.)-এর ঘোষণার উত্তরই হচ্ছে হজে লাব্বাইক বলার আসল ভিত্তি। (কুরতুবি, ১২তম খণ্ড, ২৮ পৃষ্ঠা)
ইবরাহিম (আ.)-এর ঘোষণাকে সব মানবমণ্ডলী পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে কিয়ামত পর্যন্ত হজের ধারা কায়েম থাকবে।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) বলেন, মুসলমানের অন্তরে রয়েছে মহান আল্লাহর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা। প্রতিদিন নামাজ পড়ার মাধ্যমে এই প্রেম উষ্ণতা ছড়ায়। তবে তা অন্তরের উত্তাপের তুলনায় খুবই সামান্য। আত্মার ক্ষুধা ও হৃদয়ের আকুতি মেটাতে মুসলমানরা রমজান মাসে রোজা রাখেন। রোজাদারের অন্তরে এর প্রভাবও খুবই সামান্য। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজান মাসের রোজা, প্রতিবছরের জাকাত আদায়ের পরও মুসলিমের এমন এক বসন্তের মৌসুম দরকার যখন প্রিয়ার সাক্ষাৎ ঘটবে। তাই বন্দিত্বের শিকল ভেঙে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রেম কাছে টেনে নেয় সবাইকে। ভালোবাসায় ভরপুর নতুন এই জগতে সবাই তাঁর মহিমা গাইতে থাকে। সবার কণ্ঠে বেজে ওঠে ভালোবাসার ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শরিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলকি, লা শরিকা লাক।’
মূলত প্রেমের এই ডাক মুমিনের অন্তরে অন্য রকম ঝড় তৈরি করে। স্বাভাবিক জীবনযাপনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অস্থির জীবনের স্বাদ আর কেমন হয়? ব্যক্তির প্রিয় অভ্যাস ও প্রিয় জিনিস ছেড়ে দিয়ে স্রষ্টার প্রেমের নিমগ্ন থাকার স্বাদ কি সবাই অনুভব করে? তখন অন্তরের গভীরে তাওহিদ ও ঈমানের স্বাদ উপলব্ধি করা যায়। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালি (রহ.) অত্যন্ত চমৎকার ভাষায় হজের আধ্যাত্মিক রহস্যের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় ঘরকে একটি রাজার সদৃশ করেছেন, যেখানে ভূপৃষ্ঠের নানা প্রান্ত থেকে পথিকের আগমন ঘটে। সবার অন্তরে ঘরের মহান অধিপতির আনুগত্য ও প্রেম পরিপূর্ণ থাকে। তাঁর দাসত্ব ও ইবাদতে তৈরি হয় পূর্ণ নিষ্ঠা ও অবিচলতা।’ (ইহইয়াহউ উলুমুদ্দিন, পৃষ্ঠা : ২৫০/১)
তাই হজের কার্যক্রমে এমন কিছু কাজ রয়েছে যা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এর যৌক্তিক কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন—পাথর নিক্ষেপ, সাফা ও মারওয়ার মধ্যখানে চলা ইত্যাদি। তবে এসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও তাঁর নির্দেশনা পালিত হয়। শরিয়তের অন্যান্য বিধি-বিধানের কিছু মৌলিক লক্ষ্য রয়েছে; যা মানুষের যুক্তিতেও সায় দেয়। যেমন অন্যের সহযোগিতার জন্য জাকাত দেওয়া, কুপ্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ করতে রোজা রাখা, আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করতে নামাজে রুকু ও সিজদা করা। অন্যদিকে সাফা ও মারওয়া সায়ি করা, পাথর নিক্ষেপ করাসহ হজের পুরো কার্যক্রমে মানুষ যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পায় না। এখানে মানুষের সাধারণ যুক্তি বা বিবেক-বুদ্ধির কোনো স্থান নেই। শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবী (সা.)-এর নির্দেশনা অনুকরণ করেই এসব কাজ করা হয়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘লাব্বাইক বিহাজ্জাতিন হাক্কান, তাআব্বুদান ওয়া রিক্কান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি উপস্থিত। আপনার কাছে যথার্থ হজ, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত ও পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রার্থনা করছি। (আল-হাবি, পৃষ্ঠা : ৯৭)