স্ত্রী-ছেলেসহ মতিউর রহমানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৩ মাস আগে
লায়লা কানিজ লাকি, ইনসেটে তার স্বামী এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান

ছাগলকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসা মতিউর রহমান, স্ত্রী লায়লা কানিজ ও পুত্র আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্নবের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। তবে বলা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগেই দেশ ছেড়েছেন মতিউর রহমান।

সোমবার (২৪ জুন) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার এ আদেশ দেন।

দুদকের পক্ষে এ আবেদন করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। আদালতে শুনানি করে মীর আহাম্মদ আলী সালাম। দুদকের সহকারী পরিচালক (প্রসিকিউশন সার্বিক) আমিনুল ইসলাম এ তথ্য জানান।

রোববার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মতিউর রহমানের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে। একই দিনে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। হারিয়েছেন তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও আন্ডারইনভয়েসিং, ওভারইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। জানা যায়, মতিউর রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। তাই সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকার ‘ছাগল কেনা’ ইস্যুতে তোপের মুখে পড়েন মতিউর। ইফাতের ছাগল কেনার বিষয়টি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। এরপরই তা ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়।

এরপর মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা একের পর এক সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তার দুই স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোনসহ নিকটজনদের নামে ছয় জেলায় জমি, ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্টসহ নানা সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে পুঁজিবাজারেও তার বিনিয়োগ রয়েছে। আলোচিত এই কর্মকর্তা ও তার স্বজনদের নামে থাকা এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে। তার নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। কলেজশিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

‘সম্পদের পাহাড়’ ছেড়ে আত্মগোপনে মতিউরের প্রথম স্ত্রী লাকি
এদিকে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত তরুণ মুশফিকুর রহমানের (ইফাত) বাবা রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির খোঁজ মিলছে না।

ছাগলকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি।

লায়লা কানিজ লাকি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালে রাজনীতিতে এসেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান হন তিনি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদকও।

তবে স্বামী এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে তাকে মাঠে দেখছেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

নরসিংদীতে লায়লা কানিজ লাকির আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি

নরসিংদীতে লায়লা কানিজ লাকির আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি

রায়পুরার উপজেলা কার্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন লায়লা কানিজ লাকি। কোনো ছুটি না নিলেও রোববার (২৩ জনু) অফিস করেননি। নিজ বাড়িতেও নেই তিনি। তার ওয়ান্ডার পার্কেও পাওয়া যায়নি তাকে। তাকে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এখন কোথায় আছেন, তা-ও কেউ বলতে পারছে না।

কিন্তু তিনি কেন আত্মগোপনে? তার সমস্যা কোথায়? এমন নানা প্রশ্ন স্থানীয়দের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা বলছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকি ঈদের দুদিন আগে অফিস করেছেন। ঈদের ছুটি শেষ হলেও একবারের জন্যও কার্যালয়ে আসেননি।

তাদের ধারণা, তিনি ছাগলকাণ্ডে বেশ বিব্রত। সাংবাদিকরাও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেতে তার কার্যালয়ে এসে খোঁজাখুজি করছেন। প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাই বোধহয় তিনি কার্যালয়ে আসছেন না। কবে আসবেন, তাও জানেন না তারা।

রায়পুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান জানান, ঈদের পর উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ তার কার্যালয়ে আসেননি। রোববার সকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক মিটিংয়েও তিনি অংশ নেননি। তিনি কেন আসেননি, আমাদের জানানো হয়নি। কোনো ছুটি নিয়েছেন বলেও শুনিনি।

শিক্ষিকা থেকে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের এতো সম্পত্তি জেনেই চোখ কপালে সাধারণ জনতার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রায়পুরার মরজালে ৩০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা আলিশান ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টটি লায়লা কানিজ লাকির। যা স্থানীয়ভাবে লাকি পার্ক নামেও পরিচিত। পার্কটির ভেতরের প্রায় তিন বিঘা আয়তনের লেকটি লায়লা কানিজের ‘লাকি মৎস্য খামার’ নামে নিবন্ধিত।

লায়লা কানিজ লাকির ওয়ান্ডার পার্ক

লায়লা কানিজ লাকির ওয়ান্ডার পার্ক

মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বেই রয়েছে মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি।

সরেজমিনে লায়লা কানিজের আলিশান বাড়ির চাকচিক্য দেখতে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি কেয়ারটেকার।

তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান বাড়িতে নেই। তিনি ঈদের পর একবার এসেছিলেন কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি। ঢাকায় চলে গেছেন, বাড়ি বেশিরভাগ সময়ই খালি থাকে।

জানা গেছে, গাজীপুরের পূবাইলে আপন ভুবন নামে বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট রয়েছে লাকির।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লা কানিজের সম্পদের মধ্যে ১৫৪ শতাংশ কৃষিজমি ছাড়াও রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি।

আর এসব সম্পদ ছেড়েই এখন লাপাত্তা হয়েছেন লায়লা কানিজ লাকি।

এসব বিষয়ে জানতে লায়লা কানিজ লাকির ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে।

পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক থেকেও অপসারণ করা হয়েছে তাকে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।