ফিরোজ মাহবুব কামাল:
অপরাধ: পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য কেড়ে নেয়ায়
মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সামর্থ্যটি হলো এই পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য। কারণ জীবনের চুড়ান্ত সফলতা ও ব্যর্থতাটি নির্ভর করে অনিবার্য এ পরীক্ষায় পাশের উপর। তাই অতি জরুরি হলো, জাতি কীরূপে ব্যর্থ হয় এবং আযাবে পড়ে -সে বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে জানা। বিদ্যাশিক্ষার এটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ন্যায় সেক্যুলার দেশের পাঠ্য পুস্তকে সেগুলি আদৌ আলোচনার বিষয় নয়। সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠদানের সিলেবাসটি অতি সীমিত। গুরুত্ব পায় কী করে এ পার্থিব জীবনকে সফল করা যায় –তা নিয়ে। সে লক্ষ্যেই কিছু পেশাদারী জ্ঞান ও স্কিল দেয়। এবং দেয় চাকুরী-বাকুরী ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল হওয়ার পাঠ। এ পাঠ্যতালিকায় মৃত্যু-পরবর্তী মৃত্যহীন ও অন্তহীন জীবনের কোন আলোচনা নাই। সেটিকে চেতনার প্রেক্ষাপট থেকেই দূরে রাখা হয়। কারণ, তাদের কাছে এটি অপার্থিব। ফলে সেটি অপ্রাসঙ্গিকও। এ ইহজাগতিক মতবাদটি বিলুপ্ত করে জনগণের চেতনার ভূমি থেকে আখেরাত এবং পরীক্ষা-পাশের গুরুত্ব। এবং থাকে না, জান্নাতের জন্য যোগ্যতর রূপে গড়ে তোলার ভাবনা। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা তাই কেড়ে নেয় পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য। এবং ব্যর্থ করে জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠা। এটিই হলো সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং সবচেয়ে ভয়ংকর নাশকতা।
অপর দিকে ঈমানদার ব্যক্তিকে শুধু নিজ জীবনে সফল হলে চলে না, মুসলিম উম্মাহকে বিজয়ী হওয়ার লড়াইয়েও নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগ করতে হয়। সে পরীক্ষায় দেশবাসীকে নিয়ে নিজেকে শামিল করতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয় ঐক্য, সংহতি ও সাহসিকতা নিয়ে বাঁচার। পরীক্ষা হয় সুবিচারের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মুলে নিজ অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের কুরবানীর। ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটি জাতির বহু মানুষই নেককার, নামাজী ও রোজাদার হয়, কিন্তু অন্যায়ের নির্মূল এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় জাতিগত ভাবে বিভক্ত, আগ্রহহীন এবং কাপুরুষও হতে পারে। এরাই জাতিগত ভাবে পরীক্ষায় ফেল করে এবং শত্রু শক্তির হাতের পরাজিত, অধিকৃত ও অপমানিত হয়। অতীতে সেটি প্রকট ভাবে দেখা গেছে বনি ইসরাইলীদের ক্ষেত্রে। অবিকল সেটিই এখন দেখা যাচ্ছে আজকের মুসলিমদের জীবনে। তারা যে নিয়মিত ফেল করে চলেছে -সেটি আজ আর কোন গোপন বিষয় নয়। নানারূপ ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে তারা সেটি জানিয় দিচ্ছে।
আরো পড়ুন: সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-১)
পরীক্ষাটি সর্বক্ষেত্র জুড়ে হলেও মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটি হয় রাজনীতিতে। এ জগতে যারাই কোন ধর্ম বা মতবাদে বিশ্বাসী হয়, রাজনীতি হলো সে ধর্ম বা মতবাদকে বিজয়ী করার হাতিয়ার। রাজনীতির মধ্যেই ধরা পড়ে ব্যক্তির বিশ্বাস ও বাঁচা-মরার এজেন্ডা। নামাজ-রোজার মাঝে মুনাফিকি ধরা পড়ে না, সেখানে তারা ঈমানদারদের মতই ইবাদতে হাজির হয়। কিন্তু তারা রাজনীতিতে হাজির হয় ইসলামের সাথে দুশমনি নিয়ে। এদের কারণেই বাংলাদেশর মত মুসলিম দেশে ইসলাম পরাজিত। এবং আদালতে বেঁচে নাই মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন। ইসলামের পরাজয়ের কারণ, বাংলাদেশে যে কোটি কোটি মানুষ নামাজ-রোজা পালন করে তারা ইসলামকে বিজয়ী করায় ও তাঁর শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। বরং তারা রাজনীতি করে ও ভোটি দেয় বিজয়ী করতে যাদের এজেন্ডা ইসলামী পরাজিত করায়। মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মুনাফিকি তখন সামনে বেরিয়ে আসে।
ঈমানদারের রাজনীতিতে লড়াইটি হয় দুর্বৃত্তির নির্মূলে ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়। ঈমানদার ইসলামকে বিজয়ী করার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। ফলে তার জীবনে রাজনীতির জিহাদও থাকে। সে রাজনীতি বা জিহাদ না থাকাটাই বেঈমানী। বেঈমানী হলো ইসলামকে বাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সেক্যুলারিজমের ন্যায় কোন হারাম মতবাদকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করা। এটিই হলো হারাম রাজনীতি। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে পতিতাপল্লী, মদের দোকান, জুয়ার আখড়া এবং সূদ-ঘুষ যেমন বেঁচে আছে, তেমনি বিজয়ীর বেশে বেঁচে আছে হারাম রাজনীতিও। এ সেক্যুলার রাজনীতির মূল লক্ষ্য, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকে প্রতিরোধ করা। এ রাজনীতিতে ইসলামের বিজয়ে অঙ্গীকার চিত্রিত হয় অপরাধ রূপে। এ রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশে ইসলাম আজ পরাজিত। নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত পালন দিয়ে মুনাফিক ও ফাসেকদের থেকে মু’মিনদের পৃথক করা যায় না। সেরূপ ইবাদতগুলি তারাও করে। নবীজী (সা:)’র যুগে মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই নবীজী (সা:)’র পিছনে দাঁড়িয়ে প্রথম কাতারে নামাজে খাড়া হতো। সে রোজা রাখতো। প্রকাশ্যে সে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষে সাক্ষ্যও দিত। কিন্তু তার মুনাফিকি ধরা পড়েছিল রাজনীতির জিহাদে। সেটি ওহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে।
রাজনীতির যুদ্ধটি যেমন অস্ত্রের, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তির। কে কাকে সমর্থন করে, ভোট দেয়, অর্থ দেয় এবং বিজয়ী করতে চায় – সেটি স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে রাজনীতিতে। তখন মুনাফিকদের চেনা অতি সহজ হয়ে যায়। তাদের পরিচিতিটি হলো, তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার যুদ্ধ থাকে না। বরং লাগাতর যুদ্ধ থাকে ইসলামকে পরাজিত করায়। এদের বন্ধুত্ব নানা দেশের নানা ধর্মের কাফেরদের সাথে। বাংলাদেশে এদের বন্ধুত্ব ভারতের হিন্দুত্ববাদী কাফেরদের সাথে। প্রতিটি মুসলিম দেশে এরাই হলো ঘরের শত্রু। যেসব মুসলিম দেশে ইসলামের বিজয় নাই, আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই, স্কুল-কলেজে কুর’আন-হাদীসের শিক্ষাদান নাই –বুঝতে হবে সেসব দেশের রাজনীতিতে বিজয়টি ইসলামের শত্রুপক্ষের। যদি এ শত্রুপক্ষের সৈনিকেরা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে তবে বুঝতে হবে এরা মুনাফিক।
ঈমানদার মাত্রই আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে চাইবে এবং বিজয়ী করার যুদ্ধে জান, মাল ও মেধা দিয়ে যুদ্ধ করবে –সেটিই কাঙ্খিত ও স্বাভাবিক। সাহাবাদের যুগে সেটিই দেখা গেছে। কিন্তু আজ যারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে তারা কি সবাই সেটি করে? করলে ১৬ কোটি মুসলিমের বাংলাদেশে ইসলাম কেন পরাজিত হবে? আদালত থেকে শরিয়ত কেন বিলুপ্ত হবে? এবং বিজয় কেন ইসলামের শত্রু পক্ষের -যারা ইসলামপন্থীদের জেলে নেয় এবং কুর’আনের তাফসিরে বাধা দেয়? এ থেকে বুঝা যায়, নিজেদের যারা মুসলিম রূপে দাবী করে তাদের সে দাবীর মধ্যে প্রচণ্ড ফাঁকিবাজী রয়ে গেছে। সে ফাঁকিবাজীকেই ইসলামে মুনাফিকাত বলা হয়েছে। এবং পবিত্র কুর’আনে মুনাফিকদের কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। জাহান্নামে তাদের স্থান হবে সবচেয়ে নীচে ও নিকৃষ্টতম জায়গায়। মুনাফিকদের আরেক পরিচয় হলো এরা কাফেরদের গৃহে জন্মে না, বরং ইসলামের সবচেয়ে জঘন্য এই শত্রুগণ জন্মায় এবং বেড়ে উঠে মুসলিমদের ঘরে। এদের অনেকে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয় এবং হজ্জ-উমরাহ করে। তাহাজ্জুদ পড়ার কাহিনীও অন্যদের শুনায়। মুসলিমদের আজকের সকল সংকটের মূল কারণ এই মুনাফিকগণ।