অপরাধটি হারাম রাজনীতির
ঈমানদারের জন্য শুধু পানাহার ও আয়-উপার্জন হালাল হলে চলে না, হালাল হতে হয় তাঁর রাজনীতি। মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় ইবাদত হলো রাজনীতি। একমাত্র এই ইবাদতেই ঈমানদারের শ্রম, মেধা, অর্থ, ও প্রাণসহ সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ ঘটে। এরূপ সকল সামর্থ্যে বিনিয়োগ নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতে ঘটে না। রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন ও তাঁর শরিয়তী আইন ইসলাম বিজয়ী হবে, না পরাজিত থাকবে –সেটি নির্ভর করে এই রাজনৈতিক জিহাদের উপর। শরিয়তের বিলুপ্তির অর্থ শয়তান ও তার অনুসারীদের বিজয়। এবং বিজয় কুফরি আইনের। মুসলিম জীবনে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিষয়টি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝা যায় সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭য়ে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার বয়ানে। উক্ত তিনটি আয়াতে বলা হয়েছে যারা আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফের।…তারা জালেম।… তারা ফাসেক। এজন্যই ইউরোপীয় কাফিরদের হাতে অধিকৃত হওয়ার পূর্ব বাংলা ও ভারতসহ প্রতিটি মুসলিম দেশে আদালতে শরিয়ত আইন ছিল।
সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো ইউরোপীয় কাফেরদের হাতে সংঘটিত শরিয়তের বিলুপ্তি মেনে নেয়ায়। এ কাজ কাফিরদের। কোন ঈমানদারই তার নিজ দেশে ইসলামের পরাজয় ও শরিয়তের বিলুপ্তি মেনে নিতে পারে না। মুসলিমের কাজ শুধু কুর’আন তেলাওয়াত, নামাজ-রোজা পালন এবং মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও শরিয়তী আইন অনুসারে সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। এজন্যই নবীজী (সা:)কে তাঁর সাহাবাদের নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছিল। নবীজী (সা:) ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।
মুসলিম হওয়ার অর্থ, নবীজী (সা:)’র সে মহান সূন্নতকে বাঁচিয়ে রাখা, বিলুপ্ত করা নয়। কিন্তু সেক্যুলারিস্টগণ সেটি হতে দিতে রাজী নয়। কাফিরদের মত তারাও আদালতে শরিয়তের বিলুপ্তি চায়। রাজনীতির অঙ্গণে তারা আবির্ভুত হয় ইসলামের শত্রু রূপে। তাদের বিরোধীতার মোকাবেলা করতেই মুসলিম জীবনে জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। রাজনীতির অঙ্গণে জিহাদ না থাকার অর্থ, শত্রুশক্তির বিনা যুদ্ধে বিজয়। এ জিহাদই শাহাদতের দরজা খুলে দেয়। সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতিতে ইসলামের বিজয়ে কোন অঙ্গীকার থাকে না। তাদের অঙ্গীকারটি ইসলামকে পরাজিত রাখায়। এ রাজনীতি ইসলামের শত্রুপক্ষের, কোন মুসলিমের হতে পারেনা। এ রাজনীতি হারাম।
অনিবার্য পরীক্ষাটি রাজনীতির জিহাদে
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে এক অন্তহীন জীবন দান করেছেন। এ জীবনের স্থানান্তর তথা ইন্তেকাল আছে, কিন্তু মৃত্যু নাই। আরবী শব্দ “ইন্তেকাল”য়ের আভিধানিক অর্থ স্থানান্তর। ইন্তেকাল এখানে দুনিয়া থেকে আখেরাতে। পার্থিব জীবনের স্বল্পকালীন এই দিনগুলি বাদে বাকি মৃত্যুহীন জীবনটি কাটবে আখেরাতে। সেখানে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নাম। কিন্তু কারা যাবে জান্নাতে এবং কারা যাবে জাহান্নামে -বাছাইয়ের সে কাজটি হয় এই পার্থিব জীবনে। সে বাছাইয়ের পদ্ধতিটি নিয়েই হলো আমৃত্য বিরামহীন পরীক্ষা। মানব-জীবনের অর্থই হলো এ পরীক্ষা নিয়ে বাঁচা। পৃথিবী পৃষ্ঠে মানবের জীবনে জন্ম ও মৃত্যু দেয়া হয়েছে এ কারণে যে পরীক্ষা নেয়া হবে আমলের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ –যার ঘোষণা মহান আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন সুরা মুলকের ২ নম্বর আয়াতে।
প্রতিটি ঈমানদারের জীবনে জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে এই পরীক্ষায় পাশের তাড়না থেকে। প্রবল তাড়নাটি এখানে মহান আল্লাহতয়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতয়ালার সে এজেন্ডাটি হলো, “সকল দ্বীন ও সকল মতবাদের উপর ইসলামের বিজয়।” কুর’আনের ভাষায় সেটি হলো: “লি’ইউযহিরাহু আলা দ্দীনি কুল্লিহি।” নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলার সাধনাই ঈমানদারের জীবনে সবচেয়ে বড় সাধনা। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানব জীবনে নাই। যারা সে সাধনায় নিজের দৈহিক, আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বলের বিনিয়োগ করে এবং শহীদ হয় তাদের সফলতাটি বিশাল। তাদেরকে মৃত বলা হারাম করা হয়েছে। তারা নিহত হওয়ার পরও রিজিক পান –যা বলা হয়েছে পবিত্র কুর’আনে।
ঈমানদার কতটা ঈমানদার সেটি বুঝা যায় সে মহান আল্লাহতয়ালার এজেন্ডার সাথে কতটা একাত্ম এবং কতটা নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে সে এজেন্ডার বিজয়ে। ঈমানদার তো এভাবেই নিজেকে গড়ে তোলে করুণাময়ের দরবারে মাগফিরাত লাভের যোগ্য রূপে। এভাবেই সে জান্নাত পায়। এবং মানব জীবনের প্রকৃত সাফল্য তো এই জান্নাত পাওয়াতে। অপর দিকে যে জাহান্নামে যায় –সে মৃত্যুহীন জীবন পায় জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মাঝে। পানীয় রূপে জুটে পুঁজ ও উত্তপ্ত পানি। জাহান্নামের আগুনের ভয়ই ঈমানদারের কর্ম, চেতনা ও চরিত্রে পরিশুদ্ধি আনে। তখন তাঁর প্রতিটি মুহুর্ত কাটে মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে এবং জান্নাতের মূল্য পরিশোধে। সেটি বেশী বেশী নেক আমলের মাধ্যমে। এবং সবচেয়ে বড় নেক আমলটি হলো জান ও মাল নিয়ে জিহাদ। অধিকাংশ মানুষ ভূল করে জীবনের এই হিসাব-নিকাশে ও চলমান পরীক্ষার গুরুত্ব বুঝতে।
যারা কাফের বা মুনাফিক তারা জীবনের এই পরীক্ষা নিয়ে ভাবে না। জাহান্নাম থেকে বাঁচার তাড়না তাদের মাঝে থাকে না। কারণ তারা অবিশ্বাসী আখেরাতকে নিয়ে। ফলে এ পার্থিব জীবনে তাদের ভাবনা ও কর্মই ভিন্ন। ফলে তাদের কর্ম ও চরিত্রে কোন পরিশুদ্ধি আসে না। পরিশুদ্ধি তো তাদের জীবনে আসে যারা পরীক্ষায় পাশের চিন্তা করে। এবং ভাবে জান্নাতের যোগ্য হওয়া নিয়ে। এরাই হলো সেক্যুলারিস্ট। তারা বাঁচে স্রেফ পার্থিব জীবনকে আনন্দময় করার তাড়না নিয়ে। আল্লাহতায়ালার ভয় এবং আখেরাতের ভাবনাকে দূরে রাখাই তাদের নীতি। সেক্যুলারিজমের এটিই মূল কথা। এজন্যই আখেরাতের ভয়শূণ্যতা দেখা যায় সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে। ফলে তাদের দুর্বৃত্তি ও নৃশংসতায় কোন লাগাম থাকে না। এরাই ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্ত হয়। এজন্যই কোন ঈমানদার এরূপ সেক্যুলার রাজনীতিতে কখনো যোগ দিতে পারে না।
পরীক্ষা শুধু ব্যক্তির জীবনেই আসে না, জাতীয় জীবনেও পরীক্ষা বার বার আসে। সে পরীক্ষা সকল দেশবাসীকে একত্রে মিলে দিতে হয়। জাতীয় পর্যায়ের সেসব পরীক্ষায় দুয়েক জন ভাল করলে জাতি পাশ করে না, সবাই মিলে পাশ করতে হয়। যেমন রণাঙ্গণে মাত্র দুয়েক জন ভাল যুদ্ধ করলে বিজয় আসে না, সকল যোদ্ধাকে বীরত্ব, একতা ও কুর’বানী পেশ করতে হয়। বিষয়টি অবিকল অভিন্ন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ও বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রেও। জাতির উঠা-নামা ও জয়-পরাজয় সব সময়ই একত্রে ঘটে। এজন্যই ইসলামে তাগিদ শুধু ব্যক্তি হিসাবে নয়, উম্মাহ রূপে বেড়ে উঠার। জামায়াতবদ্ধতা ও একতাবদ্ধতার গুরুত্ব এজন্যই ইসলামে এতো অধিক। এবং হারাম হলো বিভক্তি। তাই জীবনের বড় বড় পরীক্ষাগুলি দিতে হয় একতাবদ্ধ ভাবে। সেটি যেমন রাষ্ট্র গড়ার কাজে, তেমনি শত্রুর হামলার মুখে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা দেয়ার জিহাদে।
মহান আল্লাহতায়ালা তারা শ্রেষ্ঠ বান্দাদের অনন্ত-অসীম কালের জন্য নিয়ামত ভরা জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করতে চান। পরীক্ষা নিয়ে পুরস্কৃত করার মধ্যেই সুবিচার। পরীক্ষা না নিয়ে সবাইকে সমান ভাব পুরস্কৃত করা বা শা্স্তি দেয়াটাই অবিচার। কারণ, ভাল এবং মন্দ -উভ্য়ই এক নয়। বাছাইয়ের সে কাজটি করে পরীক্ষা। তাই পুরস্কৃত করার স্বার্থেই পদে পদে পরীক্ষা নেয়াটি মহান আল্লাহতায়ালার শাশ্বত সূন্নত। পুরস্কার লাভের জন্য থাকতে সে পরীক্ষাগুলিতে পাশের প্রস্তুতি। পবিত্র কুর’আনে পরীক্ষায় কৃতকার্যদের জন্য পুরস্কারের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি যারা ফেল করে তাদের উপর বর্ষিত আযাবের কাহিনীও আছে। এমন পরীক্ষা বনি ইসরাইলীদের জীবনে বার বার এসেছিল। কিন্তু জাতি হিসাবে তারা বার বার ফেল করেছিল। ফলে প্রতিশ্রুত আযাব তাদের ঘিরে ধরেছিল। পবিত্র কুর’আনে তাদের সে ব্যর্থতার কাহিনীগুলি বার বার আলোচিত হয়েছে। সে ব্যর্থতার কাহিনী বার বার তুলে ধরার কারণ, পরীক্ষায় যারা পাশ করতে চায় তারা যেন তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।