শহরকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন বিকশিত হয় তাই সিটি ট্যুরিজম বা শহুরে পর্যটন । বর্তমান সময়ে শহরের পর্যটন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চিত্তবিনোদন বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণই পর্যটন। পর্যটন ও ভ্রমণ জ্ঞান অর্জনের একটি অতি কার্যকর মাধ্যম। আনন্দের সঙ্গে জ্ঞান অর্জনের এমন মাধ্যম পৃথিবীতে আর নেই। এছাড়াও ঘুরতে বা ভ্রমণ করতে যাওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের নানা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যায়। পর্যটকরা ঘুরে বেড়ানোর জন্য সাধারণত বড় বড় শহর বেছে নেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে পর্যটন শিল্প বিকাশে ভিন্ন ভিন্ন শহর ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতের দিল্লি, মুম্বাই; পর্তুগালের পোর্তো; জাপানের ওসাকা; ফ্রান্সের প্যারিস; ইতালির রোম; আমেরিকার মিয়ামি, লাসভেগাস, লসঅ্যাঞ্জেলস; দুবাই, থাইল্যান্ডের ফুকেট; চীনের শেনজেন; তুরস্কের ইস্তাম্বুল ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোতে এসব শহরে ১৫০ কোটি পর্যটকের ভ্রমণ তথ্য পাওয়া যায়।
পর্যটন শহর স্থানীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। পর্যটনের দ্বারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব। দেশের পর্যটন শিল্প উন্নত হলে এই খাতে প্রচুর আয় করাও সম্ভব। পর্যটন শুধুমাত্র একটি শহরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে না বরং মানুষের উপর সামাজিক-সংস্কৃতির প্রভাবও ফেলে। পর্যটন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে, এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। তাছাড়া ভ্রমণের ফলে সংশ্লিষ্ট স্থানের সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়।
বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের নানা ক্ষেত্র নিয়ে কাজ হচ্ছে। একটি দেশের সামগ্রিক ট্যুরিজমকে প্রচার-প্রসারে আনার পাশাপাশি শিক্ষা ট্যুরিজম, ব্যবসা ট্যুরিজম, ধর্ম ট্যুরিজম, হেরিটেজ ট্যুরিজম নিয়ে আলাদাভাবে কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে হেরিটেজ ট্যুরিজমকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে উন্নত বিশ্ব, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, এমনকি আমাদের পাশের দেশগুলোও তাদের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোতে ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে, প্রচার-প্রসারের কাজে তারা পুরনো শহরকে ব্যবহার করছে। পোল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়ামসহ নানা দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় সব স্থাপনাই পুনর্নির্মাণ করেছে হেরিটেজ ট্যুরিজমকে মাথায় রেখে। শুধু ইউরোপ কেন; ভিয়েতনাম, কম্ব্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলংকা, ভারত প্রভৃতি দেশও হেরিটেজ ট্যুরিজমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। হেরিটেজ ট্যুরিজমের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। তৈরি হচ্ছে স্থানীয় উদ্যোক্তা, জাতীয় উদ্যোক্তা।
বিদেশ থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা নিরিখে ২০১৮ সালে জনপ্রিয় শহরের তালিকায় এশিয়ার বিভিন্ন শহরের আধিপত্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। ১০০টি জনপ্রিয় পর্যটন শহরের মধ্যে ৪১ টি শহরই এশিয়ার। পৃথিবীর বিভিন্ন শহর তাদের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিত লাভ করে। ফলে সেই শহরকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে। এতে পর্যটকের আগমন সাথে সাথে অর্থনীতি ও লাভবান হয়। শহরগুলো তাদের ইতিহাস ,ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং প্রাচীন স্থাপত্যের মাধ্যমে পর্যটক আকর্ষণ করে। যেমন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার; চীনের প্রাচীর, মিশরের কায়রোর পিরামিড, মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার, গ্রিসের এথেন্স শহর যেখান থেকে গ্রীক দ্বীপপুঞ্জ এবং ইউরোপের প্রাচীন স্থাপত্য দেখা সম্ভব, গির্জা দেখার জন্য মানুষ রাশিয়ার মস্কো ভ্রমণ করে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে সংস্কৃতি, সুন্দর খাবার এবং অপরূপ দৃশ্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় করে। এছাড়াও আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন, ডিজনি ওয়ার্ল্ড পরিদর্শনে যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ড, ইতালির ভেনিস শহরে পাথরের মধ্য দিয়ে রোমান্টিক নৌকাভ্রমন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
বিশ্বব্যাপী পর্যটন একটি বৃহৎ শিল্প যা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে খুলে দিয়েছে অসীম সম্ভাবনার দুয়ার। পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার অনেকক্ষেত্রে ঐ সব দেশের জিডিপির চেয়েও বেশি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিবছরের গড় অবদান ৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে জাতীয় আয়ের সম্ভাব্য প্রধান উৎসের একটি হিসেবে।
বাংলাদেশের এরকম অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শহরকে কেন্দ্র করে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এগুলোর স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাস প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ পাগল মানুষগুলোকে বাংলাদেশ আনা সম্ভব। এ কাজটি করা গেলে শহরকেন্দ্রিক পর্যটন আমাদের দেশেও গড়ে উঠবে। পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অধিক পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হল পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর খেলা। এ অঞ্চলের ঝুলন্ত ব্রিজ, শালবন বিহার, চাকমা রাজবাড়ী, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত সাজেক ভ্যালি যা রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত নিঃসন্দেহে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। তাছাড়া বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকত, ডোলাহাজরা সাফারি পার্ক, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন যার আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৫০০ হেক্টর। । নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ মালনীছড়া চা বাগান। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের রানীখ্যাত জাফলং, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, ‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকি এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার সৌন্দর্য।বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন শালবন বৌদ্ধ বিহার যা কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে অবস্থিত এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এছাড়াও ঢাকা জেলার মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, পানাম নগর, মহেরা জমিদার বাড়ি, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত শহীদ মিনার এসবই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। যথাযথ সুযোগ সুবিধা প্রদান করা গেলে এ স্থানগুলোর জন্যই এক একটি শহর পর্যটন শহরে পরিণত হতে পারে। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। অষ্টম শতকের শেষের দিকে নির্মিত এই বিহারটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল যা অনায়াসে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
বর্তমানে পর্যটন একটি উল্লেখযোগ্য সেবাখাত এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করা বা তাদের আহার ও বাসস্থান সংস্থান, চিত্তবিনোদন ইত্যাদির একটি ভালো ব্যবসা। শহুরে পর্যটনের ফলে শহরগুলোতে পর্যটকদের আগমন বেড়ে যায়, আর পর্যটকের আগমনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কমবেশি 20 টি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পর্যটনের সাথে বিমান পরিবহণ, হোটেল, ট্যুরিস্ট গাইড, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর নানা ভাবে সম্পৃক্ত। পর্যটন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় ও বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের একটি কার্যকর শিল্পখাত। আর যে শহরগুলোকে কেন্দ্র করে এই পর্যটন গড়ে ওঠে সেখানকার ব্যবসা বিকাশ লাভের সাথে সাথে নৌ, বিমান এবং স্থলপথে যাত্রী পরিবহণ, হোটেল ও রেস্তোরা, ব্যাংকিং, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর কোম্পানি, গাড়ি ভাড়া প্রদান ও নানা রকম খুচরা পণ্যের ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়। ফলে শহরকেন্দ্রিক পর্যটনের উন্নয়নে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি বৈচিত্রায়নে বিশেষ অবদান বা প্রভাব পড়ে।
২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারী-বেসরকারী যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুত প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙ্গা হবে বলে আশা করা যায়।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবে, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটন শিল্পের অবদান। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশে আন্তরিক। তাই এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পোষাক শিল্প এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতের পরই পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে।
লেখক: এম.জসীম উদ্দিন; তথ্য অফিসার, পিআইডি।