‘প্রাউডলি সিঙ্গেল’ নারীর সংখ্যা বাড়ছে ভারতে

::
প্রকাশ: ২ years ago
ভারতের একদল সিঙ্গেল নারী ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। ছবি: শ্রীময়ী পিউ কুন্ডু

পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় নারীদের ‘আদর্শ স্ত্রী’ এবং ‘মা’ হিসেবে দেখার চল রয়েছে। সমাজ তাদের এভাবেই বড় করে তোলে। শেখানো হয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে- বিয়ে।

তবে এমন দৃষ্টিভঙ্গীতে আঘাত করতে শুরু করেছেন ভারতের বিপুলসংখ্যক নারী। সংসারের বেড়াজালে আটকে না থেকে স্বাধীন বা সিঙ্গেল জীবন বেছে নিচ্ছেন তারা।

এমন ২৪ নারীর সঙ্গে সম্প্রতি মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন বিবিসির সাংবাদিক গীতা পান্ডে। এসব নারীর সবাই ভারতের শহুরে সিঙ্গেল নারীদের একটি ফেসবুক গ্রুপের সদস্য।

গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীময়ী পিউ কুন্ডু বলেন, ‘আসুন আমরা নিজেদের বিধবা, ডিভোর্সি বা অবিবাহিত হিসেবে বর্ণনা করা বন্ধ করি। আসুন নিজেদের গর্বের সঙ্গে সিঙ্গেল বলি।’

 

করতালিতে উল্লাস করলেন নারীরা
ভারতীয় সমাজে বিয়েনির্ভরতার ঝোঁক প্রবল। অনেকেই একা বা সংসারে না জড়ানোকে ‘কলঙ্ক’ ভাবেন।

ভারতের গ্রামাঞ্চলে অবিবাহিত নারীদের পরিবারের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। লাখ লাখ বিধবা নারীকে প্রতিবছর বৃন্দাবন এবং বারানসীর মতো পুণ্যস্থানে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

শ্রীময়ী পিউ কুন্ডুর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেয়া নারীদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক আবার কেউ আইনজীবী। এ ছাড়া সাংবাদিক, উদ্যোক্তা, লেখক, অধিকারকর্মীও আছেন এই দলে। তাদের কেউ স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন, কেউ বিধবা আবার কেউ কেউ বিয়েই করেননি।

শহুরে ধনী সিঙ্গেল নারীরা এখন ভারতের জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। ব্যাংক, গয়না প্রস্তুত, ভোগ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাভেল এজেন্সি মতো খাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

আধুনিক সংস্কৃতিও অনেক নারীকে একা থাকার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। বলিউডের সিনেমা কুইন, পিকু কিংবা ওয়েব শো ফোর মোর শট প্লিজ-এ কেন্দ্রীয় চরিত্রে সিঙ্গেল নারীকে দেখা গেছে। এসব সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল।

অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায় বলা হয়, সব নারীর (বিবাহিত/অবিবাহিত) গর্ভপাতের সমান অধিকার রয়েছে। এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে নারীবাদী সংগঠনগুলো।

তবে এসবের পরেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী খুব একটা বদলায়নি। কুন্ডু বলেন, ‘অবিবাহিত থাকা আসলে বিত্তশালীদের জন্যও সহজ কিছু নয়। সব সময় তারাও নানা প্রশ্নের মুখে পড়েন।

‘একজন অবিবাহিত নারী হিসেবে আমি বৈষম্য ও অপমানের সম্মুখীন হয়েছি। মুম্বাইতে যখন একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম, তখন হাউজিং সোসাইটির সদস্যরা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কী মদ খান? আপনি কি যৌনতায় সক্রিয়?’

কয়েক বছর আগে কুন্ডুর মা তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। অভিজাত একটি সাইটে তিনি পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। অবশেষে এক ছেলের সঙ্গে দেখা করেন কুন্ডু।

কুন্ডু বলেন, ‘প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমি কুমারী কি না?

‘এটি একটি প্রশ্ন, যা অবিবাহিত নারীদের প্রায়ই করা হয়।’

তবে ভারতের মতো দেশে নারীর পক্ষে একা থাকাটা কঠিন কিছু হওয়ার কথা ছিল না। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতে ৭ কোটি ১৪ লাখ নারী সিঙ্গেল জীবন-যাপন করছেন। সংখ্যাটি ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।

সময়ের সঙ্গে ভারতে সিঙ্গেল নারীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, সেটা ২০০১ সালে আদমশুমারির সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়। সেবার সিঙ্গেল নারীর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ১২ লাখ। ১০ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।

করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালের আদমশুমারি হয়নি। কুন্ডু বলেন, ‘ভারতে সিঙ্গেল নারীর সংখ্যা এখন ১০ কোটি ছাড়াবে।’

সিঙ্গেল নারীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ অবশ্য বিয়ের বয়স। শিক্ষার প্রসার বাড়ায় অল্প বয়সে বিয়ের হার অনেকটাই কমেছে। আগে বয়স ২০ পার হলেই তড়িঘড়ি করে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতেন অভিভাবকরা। এখন সেই প্রবণতা অনেক কমেছে।

পাশাপাশি বিধবার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। কারণ গড় আয়ু বিবেচনায় পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি দিন বাঁচেন।

কুন্ডু বলেন, ‘অনেক নারী এখন কেবল পরিস্থিতির কারণে নয়, নিজেই অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই পরিবর্তনকে আমাদের মেনে নেয়া উচিত।

‘আমি অনেক নারীকে চিনি, যারা অবিবাহিত থাকতেই চান। বিয়ের ধারণাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বিয়েকে একটি পুরুষতান্ত্রিক আচরণ মনে করেন।’

কুন্ডুর মা মাত্র ২৯ বছর বয়সে স্বামীকে হারান। সে সময় তাকে অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়; যা কুন্ডুর মনে ভীষণ দাগ কাটে।

কুন্ডু বলেন, ‘বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখছি সমাজে পুরুষহীন একজন নারী কেমন অসহায়। তাকে বেবি শাওয়ার কিংবা কাছের কারও বিয়েতেও এড়িয়ে যাওয়া হতো। কনের সামনে যেতেও বারণ করা হতো; কারণ বিধবার ছায়াকে অশুভ মনে করা হয়।’

 

‘গর্বিত সিঙ্গেল’ নারীর সংখ্যা বাড়ছে ভারতে
লাখ লাখ বিধবা নারীকে প্রতিবছর বৃন্দাবন এবং বারানসীর মতো পুণ্যস্থানে নির্বাসনে পাঠানো হয়

 

৪৪ বছর বয়সে কুন্ডুর মা প্রেমে পড়েছিলেন এবং ফের বিয়ে করেন। সে সময়েও সমাজের ‘ক্রোধের’ মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে।

কুন্ডু বলেন, ‘দুঃখ, কান্নাকাটি আর নিঃসঙ্গতাই কেন একজন বিধবা নারীর ভাগ্যে থাকবে? সমাজ খালি এটাই ভাবে, একজন বিধবা কীভাবে ফের বিয়ে করার সাহস পায়!’

মায়ের এমন অপমান কুন্ডুর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে বড় হয়েছি। আমি একটি রূপকথায় বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছি বিয়ে আমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে এবং নিজের সমস্ত অন্ধকার দূর করবে।’

কুন্ডুর জীবনেও প্রেম এসেছিল… দুইবার, তবে দুটিই ভেঙে যায়। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন কুন্ডু। ২৬ বছর বয়সে বিয়ে একপ্রকার ঠিক ছিল। তবে সেবার কুন্ডু বুঝতে পারেন, প্রথাগত বিয়ে তার জন্য নয়। কারণ এখানে বিয়ে বলতে নারীকে এক পুরুষের অধীনে জীবন পার করতে হয়।

কুন্ডু বলেন, ‘এটি এমন একটি যা সংস্কৃতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং বিয়ের ভিত্তি হলো- সম্মান, গ্রহণযোগ্যতা এবং স্বীকৃতি।’

 

‘গর্বিত সিঙ্গেল’ নারীর সংখ্যা বাড়ছে ভারতে
শ্রীময়ী পিউ কুন্ডু

 

ভারত এখনও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে বের হতে পারেনি। দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি বিয়ে পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়। একজন মেয়ে কাকে বিয়ে করবেন সে সম্পর্কে খুব কম ক্ষেত্রেই তার মতামত দেয়ার সুযোগ থাকে। তিনি আদৌ বিয়ে করতে চান কি না, সে প্রশ্ন তো দূরের কথা।

দিল্লির কাছে গুরুগ্রামের (গুরগাঁও) বাসিন্দা ভাবনা দাহিয়া। ৪৪ বছরের ভাবনা বিয়ে করেননি। তিনি বলেন, ‘সমাজে পরিবর্তন আসছে। অবিবাহিত নারীর সংখ্যা বাড়ছে।

‘আমরা সমুদ্রের একটি বিন্দু হতে পারি, তবে অন্তত এখন একটি বিন্দু তো আছে।

‘ঐতিহ্যগতভাবে বেশির ভাগ বিবাহিত নারীর কথোপকথনে থাকে স্বামীর ক্যারিয়ার, তার পরিকল্পনা, সন্তানের স্কুল নিয়ে। একজন নারীরও একটা আলাদা জীবন আছে। সেই জীবনে অনেক পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। সেই আচরণগুলোয় এখন পরিবর্তন আসছে।’