সার্বজনীন বরণীয় রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশা

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago

একজন রাষ্ট্রপতিকে সার্বজনীন তথা দেশের সব দল, সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণীয় ও বরণীয় হওয়া জর’রি। রাষ্ট্রপতি যেন ‘রিমোভ কন্ট্রোল’ না হন, ‘চাঁদের’ মতো না হন। চাঁদের যেমন কোন নিজের আলো নেই! বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া তার কোনো কাজ নেই।’ বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। তিনি যদি সবরকম কালো চক্ষু উপেক্ষা করে, রাষ্ট্রের সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে ৫/১০ বছর নয়, ১০ মাসও থাকেন, তবুও বাংলার মানুষের হৃদয়ে আজীবন অমর, অবিনশ্বর তথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবি বলেছেন, ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। বিদায়ি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদকে বাংলাদেশের মতো একটি ছোট, অভাবগ্রস্ত, দরিদ্রোচিত ও উচ্চ শিক্ষিত বেকারে ঠাসা রাষ্ট্র দু’হাত ভরে দিয়েছে। অবসরে তিনি ‘বই লিখবেন, সক্রিয় রাজনীতি আর নয়’ বলে জানিয়েছেন। এ রাষ্ট্রের জন্য (লাস্ট আলটিমেট) তিনি কি দিয়েছেন তা তার লিখিত বইতে থাকা জর’রি বলে আমরা মনে করছি।
জনাব সাহাবুদ্দিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এ সময়টা সামগ্রিক বিবেচনায় এক চরম চ্যালেঞ্জিং মোমেন্ট চলছে, বলা যেতে পারে চরম এক ক্রান্তিকাল। যখন দেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস-বিদ্বেষ দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে অস্বস্তিতে রেখেছে। সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। দেশের রাজনীতি যখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’, এমন এক জটিল সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন। নয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র আট/নয় মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদেশে যেকোনো দল নিজ দলের পরীক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ কাউকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানটিও ছিল একতরফা, যা চোখে পড়ার মতো। অনেকটা আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। বাইরের হয়তো দু-চার জন ছিলেন। স্বভাবতই বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে এখন পর্যন্ত অভিনন্দন জানায়নি; বরং বিএনপি বলে আসছে, তারা যেহেতু এ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে, ফলে সরকার কাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করল, এ নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের প্রত্যাশা নেই।’

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

গত ২৪ এপ্রিল বঙ্গভবনের দরবার হলে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবনে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দুই মেয়াদে ১০ বছর ৪১ দিনের কার্যকাল শেষ হলো। বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বিদায় অনুষ্ঠানই কেবল বর্ণাঢ্য ছিল না, বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করেছিলেন। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, পরে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এটা ঠিক, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম আসার আগ পর্যন্ত জনপরিসরে মো. শাহাবুদ্দিন খুব পরিচিত ছিলেন না। তবে ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থেকেছেন। রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে কোনো ধরনের আলোচনা বা সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখবেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার করণীয় কিছু থাকলে তিনি তা করবেন।
নির্বাচনকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, সেটি নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না, এই প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন এ নিয়ে কিছু বলব না। আমি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখব, আমার করণীয় কী আছে। আমার করণীয় যা থাকবে, তা আমি করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নির্বাচন অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে।’ একই সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার যা কিছু করার, আমি তা করব।’ তিনি আশা করেন, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, পরবর্তী জীবনে কী করবেন? জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি তো এখন রিটায়ার্ড হয়ে গেছি। দোজ হু আর টায়ার্ড, দে গো ফর রিটায়ার্ড। এখন বাড়ি বসে থেকে কিছু লেখালেখি করতে পারি। কিন্তু সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করার পরিকল্পনা নেই।’
একজন সাহসী এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের জন্ম পাবনায় ১৯৪৯ সালে। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বাকশাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সক্রিয়ভাবে। পাবনায়ই সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারাভোগ করেছেন। সয়েছেন নির্মম নির্যাতন। জেল থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেছেন কিছুকাল। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসরে যান। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর তা-ব চালায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই তা-ব তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। সে দায়িত্ব শেষে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদকের কমিশনার হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তিনি ছিলেন অকুতোভয়, তদন্তে অভিযোগটি মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়। কানাডার কোর্টেও সমর্থিত হয় প্রতিবেদনটি। এভাবে আড়ালে থেকে তিনি বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষা ও দেশকে একটি বড় কলঙ্কের দায় থেকে বাঁচিয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি অন্যতম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। পরে তাকে দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য করা হয়। সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি ঘোষিত বিভিন্ন উপ-কমিটির তালিকায় তিনি প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ‘ফিতা কাটা আর মাজার জিয়ারত’ ছাড়া আর তেমন কিছু করার নেই। তবুও চাইলে রাষ্ট্রপতি অনেক কিছুই করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সব শাখার আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার ইন চিফ)। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা বা না করা নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে সবকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচিত বিষয় হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।
একজন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ নিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রথম নাগরিক। একজন রাষ্ট্রপতির যদি চারিত্রিক সংহতি থাকে, প্রজ্ঞা ও সততা থাকে এবং থাকে গ্রহণযোগ্যতা, তাহলে তিনি দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন অবশ্যই। সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, জাতীয় সংকট সমাধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রাখতে না পারার কারণ আমাদের সংবিধান। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় এসেছে। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে করতে পারেন না। জাতীয় সংসদে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা অর্জন করবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিতে বাধ্য। একইভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগও হয়ে থাকে নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছায়। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাহীন হলেও রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে তার আলাদা মর্যাদা ও অবস্থান আছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সেটা কতা রক্ষা করতে পারবেন, ভাবীকাল তার বিচার করবে।
আইনগতভাবে একজন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আর কোনো দলের থাকেন না। তিনি হয়ে যান, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের’, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নয়’। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর মো. সাহাবুদ্দিন আর আওয়ামী লীগের কেউ নন। তিনি এখন রাষ্ট্রের প্রধান, সবার অভিভাবক, মহামান্য। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তার কাছে সর্বসাধারণ অনেক কিছুই আশা করছে। জনগণের স্বার্থে, দেশের কল্যাণে, স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ, পছন্দের প্রার্থীকে ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই ভোট দিয়ে নিরাপদে, নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে পারে, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এরকম পরিবেশ তৈরীতে আপসহীন ভূমিকা কামনা করে দেশের সর্বসাধারণ।

লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net