আগামী ১৭ আগস্ট উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। প্রবাসী বাংলাদেশি, বেসরকারি চাকরিজীবী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অসচ্ছল ব্যক্তি, এ চার শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে আপাতত সীমিত আকারে পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে বলে অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বয়সীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা থাকবে। মাসিক চাঁদা হতে পারে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কর্মসূচি পরিবর্তন এবং চাঁদার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কর্মকাণ্ড হবে অনলাইনে। সেক্ষেত্রে বিকাশ, নগদ ছাড়া অন্যান্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ব্যবহার করে চাঁদা দেওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে এ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। এর পর কর্তৃপক্ষের জন্য একটি স্বতন্ত্র অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে। বর্তমানে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে নিজ দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত হিসেবে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছে অর্থ বিভাগ। বিধি অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালন করার কথা সচিব পদ মর্যাদার কোনো ব্যক্তির।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন যে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। নানা জটিলতার কারণে অর্থমন্ত্রী ঘোষিত সময়ে তা কার্যকর করা না গেলেও কিছুটা দেরি হলেও সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু হচ্ছে।
জানা গেছে, পেনশন কর্মসূচি চালুর আগে পাঁচটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের। এগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড। ইতিমধ্যেই এসব এমওইউর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু এমওইউর মাধ্যমেই এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা যাবে না। দরকার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) করার কাজটিও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এপিআই হচ্ছে এক ধরনের সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে একটির সঙ্গে একাধিক কম্পিউটার কর্মসূচির যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কাজ হবে অনলাইনে।
দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করেছে সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দিয়েছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আইন অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৮ বছর বা ৫০ বছরের বেশি বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন; যিনি ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করবেন তিনি পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে আজীবন পেনশন প্রদান করা হবে; পঞ্চাশোর্ধরা ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে যে বয়সে উপনীত হবেন সেই বয়স থেকে আজীবন পেনশন পাবেন; প্রত্যেক চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে এবং কর্মস্থল পরিবর্তন হলেও নতুন হিসাব খোলার প্রয়োজন হবে না; কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করা হবে; মাসিক চাঁদা প্রদানে দেরি হলেও বিলম্ব ফিসহ পেনশন হিসাব চালু রাখা যাবে; ৭৫ বছরের আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে পেনশনারের নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের পেনশন প্রাপ্য হবেন; ১০ বছর চাঁদা প্রদানের আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে প্রদান করা হবে; কোনো প্রয়োজনে চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থেও সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে এবং নির্ধারিত ফিসহ তা পরিশোধ করতে হবে; বিনিয়োগ বিবেচনায় চাঁদা কর রেয়াতযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
এছাড়া, পেনশন বাবদ জমাকৃত অর্থ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠন করা হবে। এ তহবিলে চাঁদাদাতার জমা, জমার হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জীভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এবং পেনশন প্রদানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদিত হবে। এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংকে তহবিলের অর্থ রাখা যাবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনায় আইন অনুযায়ী, একটি ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এর প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। কর্তৃপক্ষের একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চার জন সদস্য থাকবেন এবং তারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন নির্বাহী চেয়ারম্যান। কর্তৃপক্ষসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার বহন করবে। গঠিত কর্তৃপক্ষ স্থাবর বা অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন, সম্পত্তি অধিকারে রাখতে ও হস্তান্তর করতে পারবে এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে নিজ নামে ঋণ নিতে পারবে। কর্তৃপক্ষ নিজ নামে মামলা দায়ের এবং আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে। এছাড়া, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের সুযোগ রাখা হয়েছে আইনে।
এছাড়া, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি পেনশন পরিচালনা পর্ষদও গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, এফবিসিসিআই সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি প্রমুখ এর সদস্য হবেন।
সৌজন্যে: রাইজিংবিডি ডটকম।