মোহাম্মদ আবু নোমান:
ফিলিস্তিনিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ইসরায়েলের প্রতি বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশ একযোগে আহ্বান জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় একটি প্রস্তাব হয়। পরে গত ৬ জানুয়ারি প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিকসহ একাধিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতকে (আইসিজে) ইসরায়েলি দখলদারির বিষয়ে একটি সুপারিশ প্রস্তাব দিতে গত ১৬ জানুয়ারি এক বৈঠক বসে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য দেশগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে ইসরায়েলের প্রতি ওই বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ইউক্রেন নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন মাতামাতির অন্ত নাই। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লংঘন করছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বিশ্বের মানবতাবোধ আর বিবেক কোথায়? পৃথিবীর কত দেশে শান্তিরক্ষি বাহিনী পাঠানো হয়। ফিলিস্তিনে কেনো শান্তিরক্ষি বাহিনী পাঠানো হয় না? ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে। ফিলিস্তিনীদের জমি দখল ও হত্যা দুটিই ইসরাইলীদের কাছে ডাল ভাত। এ বিষয়ে বিশ্ব বিবেকও ভয়ঙ্করভাবে নিশ্চুপ। গাজা কার্যত এক ছাদখোলা কারাগার। ফিলিস্তিনীরা মুসলিম, তাদের উপর অত্যাচার আর তাদের ভুমি জবরদখল করছে এমন একটি পক্ষ, যাদের উগ্রবাদ স্পষ্ট দৃশ্যমান হলেও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই! ফিলিস্তিনে মানবতার বিপর্যয় ও গণহত্যা আধুনিক সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের দাবনীয় শক্তির কাছে সবাই যেন নতি স্বীকার করছে।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ২০২২ সালে ১৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনের নাগরিক ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছেন, যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ জনের বেশি ছিল শিশু। আর এ সময়ে ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯ হাজার ফিলিস্তিনি। সম্প্রতি ইসরায়েলের নতুন সরকার গঠনের পরপরই জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী বেন গভির পবিত্র আল আকসা মসজিদ পরিদর্শন করায় অত্যন্ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকা- মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও দূরে ঠেলে দেবে বলে আমরা করে করছি।
এএফপি জানায়, পশ্চিম তীরে চলতি মাসে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় ২০ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গত ২০২১ বছরের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ৬৬ জন শিশুসহ ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। ছয়শ’ শিশু ও চারশ’ নারীসহ দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিল। সে হামলায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ছিল গুরুতর। সে সময় ২০০০ ভবন ধ্বংস হয়েছিল। ৮ লাখ মানুষ পানি সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।
সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বারবার এ ধরনের হামলার কারণে ইতিপূর্বে আয়ারল্যান্ড ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া বিশ্বের ৬০০ শিল্পী ইসরায়েলে অনুষ্ঠান করা বয়কট করেছেন। ইসরায়েলকে সাংস্কৃতিক ও একাডেমিকভাবে বর্জন করার ডাক দিয়ে ভারতের ‘ইন্ডিয়ান ক্যাম্পেইন ফর দ্য কালচারাল অ্যান্ড একাডেমিক বয়কট’ শীর্ষক যে প্রচারাভিযান জারি আছে, তার মূল কথা হলো, ইসরায়েলের মতো একটি সহিংস দখলদার এবং বর্ণবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা গভীরভাবে অন্যায্য এবং নৈতিকতাবিরোধী।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েল তার নিয়ন্ত্রণ করা অঞ্চলজুড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদি আধিপত্য বজায় রাখার অভিপ্রায় জারি রেখেছে।’
বিদায়ী বছরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থা। ইসরায়েলের সেনাদের নিয়ে এর আগেও কথা তুলেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিএইচআর। তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের সেনারা নিছক সন্দেহের বশে বা সতর্কতার জন্য ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। এটা আন্তর্জাতিক নীতিমালার লঙ্ঘন।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া খ্যাত ইসরায়েল যুগে যুগেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণবাদী, সন্ত্রাসী, দখলদার ও দখলদার দেশের সহযোগী হয়ে দানবীয় শক্তি দেখিয়েছে। যার জন্য এই ইহুদিদেরকে খ্রিষ্টানরা মেরেছে! নাতসিরা মেরেছে! ইংরেজ ও ব্রিটিশরা মেরেছে! ইউরোপ থেকে নির্বাসিত হয়েছে! এডলফ হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি মারার পর তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন- ‘আমি ইচ্ছা করলে সব ইহুদিদেরকে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কিছু রেখে দিলাম এ জন্য যে, পরবর্তী প্রজন্মরা বুঝতে পারে ওরা কত জঘন্য, আর কেন আমি ইহুদি বিদ্বেষী ছিলাম’।
আমেরিকা-ইউরোপের সাহায্য ছাড়া সন্ত্রাসী ইসরাইল তাদের অবৈধ অস্তিত্ব টিকানো কল্পনায়ও সাহস করতে পারে না। বুর্জোয়া আমেরিকা-ইউরোপ ভালো করেই জানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য লড়াইয়ে আরবদের কিছুই করতে পারেনি, তাই শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকে তাদের দাবার গুটি বানিয়ে খেলছে। আমেরিকা প্রশাসন বরাবরই নানা কারণে অনৈক্যে লিপ্ত অদুরদর্শি মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে।
ইসরায়েলের লক্ষ্য হামাসের প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননকে রাজপথে নামানো। একটিতেও তারা বিজয়ী হয়নি। বরং রাজনৈতিক ফ্রন্টেও তারা বারবার পরাজিত হয়েছে। সামরিক দিক থেকে হামাস পৃথিবীর অন্যতম সেরা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে শত বছর এগোনো, ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো পরাশক্তির সমরযন্ত্রকে উড়িয়ে দিতে না পারলেও বহুবারই পিছু হটতে বাধ্য করেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, গাজায় হামলার পর ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যেও হতাশা লক্ষ্য করা গেছে! দেশটির চ্যানেল ১২-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক পাইলট স্বীকার করেছেন, ‘আমরা রকেট হামলা ঠেকানো ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে ধ্বংসে ব্যর্থ হয়ে তাদের ভবন ধ্বংস করে হতাশা মিটিয়েছি।’
নেতানিয়াহু বিদায় নেওয়ার বছরও গাজায় ভয়াবহভাবে নিপীড়ন, ৬৫টি শিশুসহ আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেও মাথা নিচু করে বিদায় নিতে হয়েছিল। পদ হারানোর পর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বির’দ্ধে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলকে কাঠগড়ায় দেখতে আরও বেশি আগ্রহী বলে দেখা যাচ্ছে।
ইসরায়েলের ফিলিস্তিন ও আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্টকারী যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমের সঙ্গে ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে একটি সার্বভৌম ও কার্যকর রাষ্ট্রের জন্য ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১০ জানুয়ারি জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ওআইসির স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এ কথা বলেন। সম্প্রতি জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে সংঘটিত ইসরায়েলের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে এই সভা হয়।
ফিলিস্তিনে যা চলছে, তা কোনো নৈতিক আচরণবিধির মাপকাঠিতে ন্যায়সংগত হতে পারে না। ফিলিস্তিন মূলত একটি আরব দেশ এবং তাকে আরব দেশ হিসেবেই থাকতে দিতে হবে বলে আমরা মনে করি।
গত মে মাসে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলি শরীরে লাগার পর উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন একজন নারী। নিথর শরীর। পরনে জ্যাকেট। তাতে লেখা ‘প্রেস’। বলছি আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের কথা। তাকে আর বাঁচানো যায়নি। শুধু সাংবাদিক শিরিন আকলেহই নন। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলি দখলদারদের শিকার হচ্ছেন আপামর ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ এমনকি গণমাধ্যম ভবনও। ২০২২ সালটাও ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা ছিল না। ইসরায়েলের দখলদারি, অভিযান আর নৃশংসতায় এ বছরটিও ছিল তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। খোদ জাতিসংঘ বলেছে, ২০০৬ সালের পর বিদায় নিতে যাওয়া বছরটি ছিলো পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের।
ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বুকে অবৈধ ও বেআইনিভাবে গড়ে তোলা এক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল এবং ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা ও উচ্ছেদের মাধ্যমে গড়ে তোলা এই রাষ্ট্র প্রথম দিন থেকেই সন্ত্রাসী আচরণ করে যাচ্ছে। কেবলমাত্র এই অবৈধ রাষ্ট্রের বিলোপ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হতে পারে আরব-ইসরায়েল সংকটের সমাধান। একটা সময় আসবে যখন অবৈধ দখলে সাধের বসতি ছেড়ে চোখের জল সঙ্গী করে চলে যেতে হবে ইহুদীদের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতা ও আগ্রাসন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে চলেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন বৈশ্বিক সংকট এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের গুরুতর পরিস্থিতি থেকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ যাতে সরিয়ে না নেয়, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।