শেখ হাসিনার নির্বাচন জয় ও ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ | শর্মিলী মাহজাবীন

:: শর্মিলী মাহজাবীন ::
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নবনির্বাচিত সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা যথাক্রমে ১০ ও ১১ জানুয়ারি শপথ নেন। বিরোধী দলগুলো একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার্থে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। বিরোধী দলগুলোর বিক্ষোভ ও বয়কটের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ১৮টি দল বিরত থাকে।

ভারত নির্বাচনের ফল ঘোষণার অব্যবহিত পরেই নবনির্বাচিত সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে এবং সরকারের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চিঠি ও ফোন উভয় মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে তার অভিনন্দন বার্তা জানিয়েছেন। এক্স-এ একটি পোস্টে প্রধানমন্ত্রী মোদি লিখেছেন, ‘নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করায় আমি বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই। আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের স্থায়ী ও জনগণকেন্দ্রীক অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের একটি ‘মহৎ বন্ধু’ এবং দুই প্রতিবেশী দ্বিপাক্ষীকভাবে অনেক সমস্যার সমাধান করেছে।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের রয়েছে দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত। যার ফলে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার নিকটতম প্রতিবেশী দেশে একটি নির্ভরযোগ্য সরকার প্রয়োজন। ফলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, এটি শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়, কারণ হাসিনা সরকার তার শাসনামলে ভারতীয় সংবেদনশীলতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বকালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বেশকিছুক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহ-বিরোধী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ট্রানজিট সুবিধার ব্যবস্থা এবং বঙ্গোপসাগরের দুটি প্রধান বন্দরে ভারতকে স্থায়ী প্রবেশাধিকার প্রদান। উপরন্তু, দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি চুক্তি হয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে একটি নজরদারিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্যতা অনেক ভারতীয় কর্মকর্তার বক্তব্যে স্পষ্ট। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বেশ কয়েকবার বলেছেন যে ভারত একটি ‘স্থায়ী অংশীদার’ হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং একটি ‘শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ভবিষ্যতের জন্য তার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে যে শেখ হাসিনা কার্যকরভাবে এই অঞ্চলে চরমপন্থার বিস্তার রোধ করেছেন এবং আওয়ামী লীগ দুর্বল হলে কট্টর ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা পুনরায় বৃদ্ধি পাবে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ভারত সফলভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করেছে।

এছাড়াও, বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্য ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার করে তুলেছে। ভারত সড়ক, রেলপথ, নৌপরিবহন এবং বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সর্বমোট ৮ বিলিয়ন ডলারের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। গতবছর নভেম্বরে নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা যৌথভাবে আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন, খুলনা-মংলা রেল সংযোগ ও বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ইউনিট উদ্বোধন করেন।

ইতোমধ্যে, যখন এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলি ধীরে ধীরে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরে গেছে তখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসাবে নয়াদিল্লির নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য, ভারতের তার নিকটতম প্রতিবেশী দেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চায়, যা ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের পারস্পরিক স্বার্থকে সম্মান করবে। এতদসত্ত্বেও, শেখ হাসিনার সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে এমন বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে, যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক বিশ্লেষক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ভারতের পক্ষে একতরফা বলে অভিহিত করেন, যার ফলে হাসিনা সরকার যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়ে।

বিতর্কিত দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলোর মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সবচেয়ে আলোচিত। বাংলাদেশের ক্রমাগত অনুরোধ সত্ত্বেও, এটি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত রয়েছে। যদিও ২০১১ সালে চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তা আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেটিকে তার একটি অর্জন হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে পড়া তিস্তা চুক্তি এখন তার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে খারাপ হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দ্বারা হত্যার সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। যদিও ভারতীয় পক্ষ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, কিন্তু তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ এবং বাংলাদেশ সরকারের ক্রমাগত অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো গ্রহণ করেনি। এটি ভারত নিয়ে জনগণের মাঝে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে এবং বিরোধীদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে শেখ হাসিনা সরকার।

দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও বাণিজ্য উদারীকরণ এখনও ঘটেনি। দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিগত কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। আমদানি-রপ্তানি ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে খুবই কম। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহজ করতে এবং বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য, দুই দেশ একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির বা সেপা প্রস্তাব করেছিল, যা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই শেখ হাসিনা সরকারের জন্য মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু মূল্যস্ফীতি এখন চলমান রয়েছে, নতুন সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় ভারত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, ভারতের সাম্প্রতিক কিছু কৃষিপণ্য, বিশেষ করে পেঁয়াজ, চিনি ও চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব ফেলেছে।

গত বছর কোটা সুবিধার আওতায় ভারত থেকে ৬টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানির বিষয়ে দুই দেশের কর্তৃপক্ষের মধ্যে দুই দফা আলোচনা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে বলে শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন।

ভারত তার প্রতিবেশী দেশে স্থিতিশীলতা দেখতে চাইলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে হবে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’ মনোভাব পরিবর্তন করে বন্ধুত্বের মনোভাব পোষণ করেত হবে। এবং সবশেষে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে পর্যালোচনা করতে হবে যেনো তাতে উভয় দেশের জনগণের স্বার্থ প্রতিফলিত হয়।

লেখক: শর্মিলী মাহজাবীন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]