শিরোনাম হোক ‘পাসের হার শতভাগ’: গুণগত শিক্ষায় বাংলাদেশ

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। একটা জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সেই জাতিকে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে আমাদের বাবা-মা, শিক্ষক ও গুরুজনরা সব সময় এ কথা বলতেন। এসব শোনো শোনে আমরা বড় হয়েছি। আশি-নব্বইয়ের দশকে মাধ‍্যমিক, উচ্চমাধ‍্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে পাসের হার এখনকার মতো এত বেশি ছিল না। জিপিএ, সিজিপি ছিল না, ছিল ডিভিশন, ক্লাস পদ্ধতি। পাশাপাশি স্টার মার্ক ও বোর্ড স্ট্যান্ড। এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১ম থেকে ২০তম স্থান অর্জনকারীদের বলা হতো বোর্ড স্ট্যান্ড। ওই সময় বোর্ড স্ট্যান্ডদের অনেকের সাক্ষাতকার টিভির খবরে দেখানো হতো। স্ট্যান্ডের ব্যাপারে ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজগুলো এগিয়ে থাকতো। মফস্বলে কেউ স্ট্যান্ড করলে এলাকায় হৈ চৈ, আনন্দ-উল্লাস শুরু হয়ে যেতো। এলাকাবাসী তাকে নিয়ে গর্ব করত।

এখনকার মতো আমাদের সময় মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ছিল না। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে স্কুলে নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হতো। পরের দিন প্রতিটি জাতীয় দৈনিক বোর্ড অনুযায়ী স্কুলের নামসহ রোল নম্বর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করত। প্রতিটি বিষয়ে ৮০ মার্ক পেলে বলা হতো লেটার মার্ক। আমাদের সময় ভালো ফল করতে প্রতিটি নম্বরের জন্য যুদ্ধ, প্রতিটি বানান শুদ্ধ, উত্তর নিখুঁত করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ছিল। যেটার চর্চা মনে হয় আজ আর নেই।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

আমার কেন এমনটা মনে হয়। কারণ ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ ‘যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পেল না ঢাবির সংস্কৃত বিভাগ’। ২০১৬ সালে এস এস সি-তে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রের ‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি’ কথাটির ইংরেজি অনুবাদ ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার খবর।

শুনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে শিক্ষক হতে আবেদন করেন ১৬ জন। আবেদনকারীরা একাডেমিক ফলাফলে সবাই শীর্ষে। তবে ভাইভা বোর্ডে ভাষা-সংস্কৃত বিষয়ে ন্যূনতম লিখতে বা পড়তে পারে নাই কেউই। এমনকি অক্ষর চিনতেও অস্বাভাবিক সময় নেন অনেকে। হতাশ হয়ে শূন্যপদে কাউকেই নিয়োগের সুপারিশ করতে পারে নাই বোর্ড। অপরদিকে ২০১৬ সালে এস এস সি- তে সারা দেশে গড় পাসের হার ছিল ৭৮.৩৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার। অনেক শিক্ষাবিদের মতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস ও ক্লাসে আসার প্রবণতা বেড়েছে। তাই পাসের হারও বাড়ছে। ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। আমরা কি পারছি গুণগত মান বৃদ্ধি করতে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংস্কৃত বিভাগে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করতে না পারা এবং এস এস সি-তে জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রের আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার খবর কি তা প্রমাণ করে? এমন খবরে আমি রীতিমতো হতবাক।। জাতির মেরুদন্ড: সামনে কি ঘোর অমাবস্যা..”

প্রশ্ন শিক্ষার মান কেন এমন হলো। এটা কি শুধুই মুখস্ত বিদ‍্যা, নির্দিষ্ট সংখ‍্যক প্রশ্নের উত্তর শিখে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখার ফল। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়া উত্তর লিখে কতিপয় অযোগ‍্য ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে চান্স। অভিভাবকদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের জিপিএ ৫ নিয়ে ভালো ফল করানোর প্রবণতা, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানানোর পেছনে দৌড়ঝাঁপ। অভিভাবকের এমন অস্থিরতা ও প্রতিযোগিতার মানসিকতাকে পুঁজি করে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের রমরমা ব্যবসা। সেকেলে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় প্রভাবে যোগ‍্যদের পরিবর্তে অযোগ‍্য শিক্ষক ও ভিসি নিয়োগ। লেজুর ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি। আসল গলদটা কোথায়?

আশাকরি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতারা সচেষ্ট হবেন। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে পুথিগত বিদ‍্যার পরিবর্তে গণমুখী শিক্ষা, জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, এবং সত্যিকার মানুষ গড়ার শিক্ষা পদ্ধতি চালু করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যদি কোনো শিক্ষকের বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা থাকে, তাহলে ওই শিক্ষককে যথাযোগ্য পদে নিয়োগ করবেন। যেমন-বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর খান সরওয়ার মুরশিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আবুল ফজল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মুহম্মদ এনামুল হক এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. রশীদকে বহু সাধ্যসাধনা করে উপাচার্য হতে রাজি করিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়েও যাঁরা তাঁর আমলে উপাচার্য হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ‍্য শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে শিগগির বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষার সুনাম ফিরিয়ে আনবেন।

ছাত্রছাত্রীদের পুথিগত বিদ্যার জ্ঞানে নয় সত্যিকার শিক্ষায় জ্ঞান অর্জনে ‘যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পায়নি এবং আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ মিডিয়ার এমন শিরোনাম ধুয়ে মুছে যাবে। শিরোনাম হবে পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের পাসের হার শতভাগ: বিশ্বে গুণগত শিক্ষায় শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশ।

লেখক: মো. নবী আলম, উন্নয়ন কর্মী।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net