শারদীয় পূজা আসন্ন, ব্যস্ত মৃৎ শিল্পীরা

:: অমিতা সিনহা ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে
প্রতীমা বানাতে ব্যস্ত মৃৎ শিল্পীরা। ছবি: অমিতা সিনহা

শরতের কাশ ফুলের মৃদু বাতাসে বছর ঘুরে আবারো দেবী পূজার মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠেছে চারিদিক। দুয়ারে কড়া নাড়ছে শারদীয় দুর্গা পূজা। মর্ত্য লোকে দেবী দশভুজা মায়ের আগমনী বার্তায় পূজা পাড়ায় লেগেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে নানান রকম ব্যস্ততা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততা বেড়েছে মৃৎ শিল্পীর পাড়ায়। দিনরাত এক করে দেবী মায়ের প্রতিমা সৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে তারা।

আসছে ১৪ অক্টোবর দূর্গতনাশীনী দেবী দূর্গা মায়ের মহালয়া। শাস্ত্রমতে, মহালয়ার দিনে দেবী দূর্গা মায়ের বোধন(জাগরণ) করা হয়। এজন্য এই দিনে দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসে শারদীয় দুর্গাপূজার সূচনা করা হয়। শ্রাবণ থেকে পৌষ ছয় মাস দক্ষিণায় দেবতাদের ঘুমের কাল। এ সময় বোধন করে দেবতাদের জাগ্রত করা হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয়, সেই সময় সংকল্প করে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় মর্ত্যলোকে। এ বছর দেবী দুর্গা মা ঘোটক অর্থাৎ ঘোড়া বাহনে চড়ে শ্বশুর বাড়ি কৈলাশ থেকে বাপের বাড়িতে আসবেন। ফিরবেন একই বাহন দিয়ে।

বাহনের প্রতীক নির্ণয় হয় এবছর কেমন যাবে। যেহেতু দেবী দুর্গা ঘোটকে আগমন আর গমন একী বাহন দিয়ে , সেহেতু এ বছর শাস্ত্র অনুসারে অশুভ সঙ্কেত। ‘ছত্র ভঙ্গ স্তু রঙ্গমে ’ অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতা দেখা দেবে। এতে করে রাজায়-রাজায়, রাষ্টে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ সূচিত হবে। আর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধ্বংস ও অস্থিরতা বিরাজ করবে। এবার হিন্দুধর্মের শাস্ত্রে অনুসারে, ২০ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হবে। শেষ হবে ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে।

হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। দেবী দুর্গা মায়ের আরেক নাম পার্বতী। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন দেবা শিবের স্ত্রী পার্বতীকে পুজার মধ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করার জন্য। এর ফলে রাবণকে বধ করা সহজ হবে। উনার পরামর্শ অনুযায়ী শরৎকালে দেবী পার্বতীকে পূজা করার নির্ণয় নেন। কিন্তু শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। অকালে পূজার আয়োজন করার জন্য রামকে সহযোগীতা করে ব্রহ্মা দেবী দুর্গার বোধন(জাগরণ) পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে দুর্গা মায়ের বোধন পূজা বলে। এক পর্যায়ে রাম শরৎকালের আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ করেন। তারপর গধূলী লগ্নে বোধন আমন্ত্রণ আর অধিবাস সম্পন্ন করেন।

দূর্গা পূজা উপলক্ষ্যে সিলেটে নির্মিত বিভিন্ন প্রতীমা। ছবি: অমিতা সিনহা

রাম পর্যায়ক্রমে ষষ্ঠীর পর মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজা করেও দেবী পার্বতী মায়ের আর্বিভাব না হওয়ায় ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন তিনি। এ সময় তারই প্রাণ প্রিয় ভক্ত হনুমান ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। কিন্তু রাম পূজাতে বসে ১০৮টি পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম না পেয়ে নিজের একটি চোখ উপড়ে পূজাতে দেবীকে নিবেদন করতে গেলেন। তখন দেবী পার্বতী আবির্ভূত হন। কিন্তু দেবী পার্বতী নিজেই একটি পদ্ম লুকিয়ে ছিলেন। এমন ভক্তি পূজা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী রামকে সেই কাঙ্খিত বর দেন।

সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় পূজা হচ্ছে দুর্গাপূজা। এই পূজা মহাপূজা। এই পূজাতে মহাত্মন পূজন, হোম ও বলিদান বাধ্যতা মূলক করা হয়। দেবী দুর্গা পূজাতে মন্ত্রের সঙ্গে শ্রী শ্রী চন্ডী পাঠ করে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল, শঙ্খ ও ঘন্টা বাজানো হয়। এসময় ধূপ ধুনার সুগন্ধী ধোঁয়া, ফুল মালা নৈবেদ্য -চন্দন অগুরু -কস্তুরী-কর্পূরের মিলিত সুগন্ধের মধ্য দিয়ে একত্রে এক পবিত্র পূজার ভাবগম্ভীর্য সৃষ্টি হয়। সিলেট শহরের দারিয়াপাড়ার মৃৎ শিল্পী পাড়ায় পরিদর্শনকালে দেখা যায়, মাটি- ক্ষের-বাঁশ- লোহা-দড়ি-তুলি- রং ও পানি দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সাইজের দেব-দেবীর প্রতিমা। কোনো কোনো প্রতিমাতে সাদা রং পড়েছে। কোনোটিতে এখনো প্রতিমার আকৃতি তৈরি করে শুঁকানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে আলাপে ৫৮ বয়সী দুলাল পাল বলেন, আগে এক সময় পূজার মৌসুম আসলে প্রতিমার অর্ডারতা আসতো বেশি। এখন সেই মৌসুম আর নেই। এখন ১২মাস আমি শুধু প্রতিমা তৈরি করে জীবনযাপন করছি। যার দরুণ সারা বছর ব্যাপী দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যখন হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় পূজা দুর্গা পূজা চলে আসে, তখন প্রতিমার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ৬/৭বছর আগে দুর্গা পূজার প্রতিমার অর্ডার পেতাম ৫০টি মতো। এবছর অর্ডার পেয়েছি ১২টির মতো। প্রতিমার মধ্যে কোনোটির মাটি দিয়ে কাপড় পরিধান থাকি। আর কোনোটিতে কাপড় দিয়ে প্রতিমাতে পরিধান করা হয়। এক সেট প্রতিমায় নিন্মে মূল্য থাকে ৫০হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ মূল্য ১লাখ টাকা। অবশ্য এবার রেডিমেড তৈরি মূর্তির বেশিভাগ বিক্রি হচ্ছে।

সিলেট/ অমিতা সিনহা/ ৫ অক্টোবর ২০২৩ ইং।