শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রহ. এক জীবন্ত ইতিহাস

::
প্রকাশ: ২ years ago

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী:
চির অমর শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রহ. এক জীবন্ত ইতিহাস। হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী। আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের মুকুটহীন সম্রাট হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহ.) এর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম উত্তরসূরি হযরত শাহ কামালের বংশধর এবং ইসলামিক চিন্তা-চেতনার প্রচার ও প্রসারে ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান প্রাণপুরুষ শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) এক জীবন্ত ইতিহাস, গৌরবের কিংবদন্তি। সত্য-ন্যায় এবং আহলে সুন্নাতওয়াল জামাতের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন, পাশাপাশি জ্ঞানের আলো বিতরণে নিরলস চেষ্টা করেছেন। দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল একটি ভালো জীবন বলতে জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত জীবনকেই বুঝিয়েছেন। শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) তাঁর সমগ্র জীবন প্রবাহে জ্ঞানের প্রচার-প্রসার এবং সত্য সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

ফুলতলী (রহ.) আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তায় ও বিশ্বাসে অনিন্দ্য সুন্দর উপাসনা আর বলিষ্ঠ ও প্রখর ব্যক্তিত্বের গুণাবলী সবার মাঝে ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের বিভিন্ন গুণাবলি আমাদেরকে সঠিক পথ চলতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তিনি ছিলেন একজন যুগ শ্রেষ্ঠ খ্যাতিমান আলেম। তাঁর আপাদমস্তক ছিল রাসূল (সাঃ) এর আদর্শে উদ্ভাসিত। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী প্রত্যেক নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত এবং মজলুম মানুষের পক্ষে সু-উচ্চ কন্ঠস্বর।

তিনি ছিলেন জালিম ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিশেষ করে তাগুতের বিরুদ্ধে তাঁর সময়োপযোগী এবং সাহসী কন্ঠ ছিল ধারালো তরবারির চেয়েও কঠোর। রাসূলে পাক (সাঃ)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত এ মহান ব্যক্তির মাঝে ছিল প্রেম, প্রীতি, স্নেহের ও ভালোবাসার মধুর সুর, অনাচার নির্যাতনের এবং সকল বাতিলের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বিদ্রোহের প্রতীক। তিনি কখনো ছিলেন কোমল আবার কখনো কঠোর এক প্রাচীর। ইসলাম প্রচারে তথা আল্লাহ তায়ালার দ্বীন কায়েম করতে এবং রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসৈনিক।

ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় ফুলতলী (রহ.) এর চরিত্র, আচার-আচরণ ও ব্যবহার ছিল নম্রতা ও ভদ্রতায় পরিপূর্ণ। জীবনের ঊষালগ্ন থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম জাতির ক্রান্তিকালের উত্তরণের চিন্তা মাথায় নিয়ে যারা সামনে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দীপ্ত কঠিন শপথে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব ফুলতলী (রহ.) এর অভিযাত্রা অন্যতম। তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদিসকে সামনে রেখে বাতিলের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যান।

কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস সহ ধর্মীয় প্রত্যেক কিতাবের মর্মবাণী উপলব্ধি করে সফলতা ও কৃতিত্বের সাথে উপস্থাপন করে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষাবিদের মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। ঈমান আক্বিদা রক্ষার আন্দোলনে তাকে পাওয়া যেত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো। বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী নামে পরিচিত সিলেটের মুকুটহীন সম্রাট হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহ.)-এর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ কামালের নয়নের মধ্যমণি হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, অবিচল, নিরহংকার, খোদাভীরু, শান্তিপ্রিয় রাসূল প্রেমিক। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যকার শান্তি সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ইসলামি চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে তিনি সু-লেখক, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, মিষ্টভাষি সুবক্তা, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম বীর সিপাহসালার শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.)-এর অন্যতম চিন্তার চেতনার হাতিয়ার আনোয়ারুস সালিকিন অথবা নালায়ে কলন্দর নামে কাব্যগ্রন্থ দু’টি বরেণ্য কবিদের চেয়ে কম নয়? এছাড়া পবিত্র আল কুরআন সহিহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াতের জন্য তাঁর অন্যতম একটি রচনা হল আল কাউলুস ছাদীদ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণে শামসুল উলাম আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) কে ভাবিয়ে তুলেছিল অনেক। তাই তিনি প্রত্যেকের কল্যাণের জন্য নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত লতিফিয়া এতিমখানা বাদে দেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা, সোবহানীঘাট কামিল মাদরাসা, বৃদ্ধানিবাস প্রকল্প, ফ্রি ডিসপেনসারী, লতিফিয়া শিক্ষা কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষক সংগঠন জমিয়তুল মোদারিছীন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পবিত্র আল কুরআন বিশুদ্ধভাবে পড়ার সাড়া জাগানো দারুল ক্বিরাত মাজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও অনেক অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম হৃদয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

আশি দশকের সৈয়দপুরে বাতিলপন্থীদের হাতে রক্তেরঞ্জিত হয়েও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.)কে রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শ হতে একবিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত করতে পারেনি। আজও তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তাচেতনার বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার দুঃসাহস, নোংরা রাজনীতি অথবা আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অপচেষ্টা অবশ্যই সফল হবে না। কেননা পবিত্র কোরআনের ভাষায় সত্য সমাগত আর মিথ্যা বিতাড়িত। কাজেই কোনো মিথ্যা ষড়যন্ত্র কোনো কালেই জয়ী হয়নি, আর কখনো হতে পারে না।

ক্ষণস্থায়ী জীবনের ইতি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আল্লাহতায়ালার তাঁর প্রিয় বান্দাদের কাছে আজরাঈল যখন হাজির হন তখন তারা পরম আনন্দে মাওলার দিকে পাড়ি জমান। ঠিক এভাবে পাড়ি জমান মাওলার সান্নিধ্যে ১৫ জানুয়ারি ২০০৮ মঙ্গলবার দিবাগত রাতে প্রায় ২টা ৯ মিনিটের সময় ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বীর সিপাহসালার সুন্নতে নববীর আদর্শ শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) মাওলার ইশারায় প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরেণ্য এই ব্যক্তির ইন্তেকালে দেশ-বিদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। চারদিকে শোকার্ত মানুষের ঢল। প্রত্যেক আপামর জনসাধারণ ছুটেছেন প্রিয় রাহবারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ফুলতলীর বালাই হাওরের প্রান্তরে। ১৬ জানুয়ারি লক্ষ লক্ষ জনতা তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সম্মান জানাতে জমায়েত হতে থাকেন ফুলতলী ছাহেব বাড়ি। ভক্তদের আহাজারি আর কান্নায় ভারি হয় গোটা ফুলতলী বালাই হাওরের পরিবেশ। প্রিয় মুর্শিদের ইচ্ছা মোতাবেক তাকে নিজ বাড়ির মসজিদের উত্তর দিকে দাফন করা হয়। চির অমর মহান এই ওলি এ পৃথিবীতে আর কখনো ফিরে আসবেন না। তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি জাগরুক থাকবে হাজার বছর ধরে।

আমার স্বপ্নে কল্পনায় ও শ্রদ্ধায় চির অমর শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) আমার আস্থার ও ভালোবাসার প্রতিক। এটি আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয় একটি সংকল্পের, একটি আদর্শের, একটি সংগ্রামের, একটি লক্ষের, একটি সোনালী ইতিহাসের নাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানবতা আজ নির্বাক, গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত, চারদিকে আজ মুসলমানদের লাশ আর লাশ, বারুদের গন্ধে চরম শূন্যতায়, আজ আল্লাহর নেক ওলির হুংকার কে স্মরণ করছি। আজ যেন আমরা তাঁর রেখে যাওয়া রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করতে পারি। মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই প্রার্থনা করছি। পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে ফরিয়াদ করি আমার পীর ও মুর্শিদকে আল্লাহ পাক যেন জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন, আমিন। আল্লাহ পাক যেন আমার পীর ও মুর্শিদের রুহানি ফয়েজ আমাকে দান করেন,আমিন।

লেখক: সাবেক ইমাম ও খতিব, কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।