সরোজ মোস্তফা:
১৯৪৯ সালে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ‘রূপালী স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সারস্বত সমাজে শামসুর রাহমানের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আত্মবিশ্বাসের শমিত আয়োজনে আরো এক যুগ পরে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে ত্রিশীয় অনতিক্রম্যতায় জীবনানন্দ দাশের ভাব ও প্রকৃতি উপস্থিত থাকলেও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে স্পষ্ট হয়েছে নিজস্ব ধ্যানের কাব্যভাষা, বিষয় ও ধ্বনির শিল্পায়ন।
পঞ্চাশের দিনগুলোতে অবগাহন করেও শামসুর রাহমানের প্রকৃত কাব্যভাষা জাগ্রত হয়েছে ভূমির বিষাদে। ত্রিশীয় কাব্যচেতনার ভেতরে লালিত ও আদর্শায়িত হলেও মানুষ, সমকাল, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অতল উচ্চারণকে তিনি কবিতা করে তুলেছেন। ত্রিকালদর্শী জ্ঞানের অম্লান মুহূর্তগুলোই শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা। ব্রিটিশ শাসন, সাতচল্লিশের দেশভাগ, পাকিস্তানি আমলের বিরূপতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্মস্রোতে জাগ্রত ছিল কবির কলম। ব্যক্তিত্বের টান টান উজ্জ্বলতায় বাংলাদেশের সব আন্দোলনে সচল মমতায় জাগ্রত ছিল কবির সিগনেচার। সময়ের ধাবমান দ্রোহ, ক্রোধ, রাজনীতির নিত্যতা আর বিকাশমান বাংলাদেশের রূপ থালাভরা একরাশ চাঁপাফুলের হাসির মতো প্রস্ফুটিত হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়।
একটা আদর্শিক, সৎ ও সুষমামণ্ডিত জীবন কাটিয়েছেন কবি। ব্যক্তিত্বের অবিচল দৃঢ়তায় সব রকম লড়াই-সংগ্রাম এবং সমাজ জাগ্রত সময়ের প্রতিনিধি হয়েছেন তিনি। তাঁর কবিতার তাপে বাংলাদেশে নেমে এসেছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দ্রোহ। কবিতা মূলত একার সন্ন্যাস। কল্পনা ও ভাষার নিজস্ব পরিক্রমায় সমকাল কিংবা যাত্রাপথে মায়া পাঠে গোত্রসাথিদের সঙ্গ ও স্বরের ভেতরে থেকেও আত্মযাপনের পবিত্র মুহূর্তে উচ্চারিত হয় একার সন্ন্যাস। যে কণ্ঠ সবার, সে কণ্ঠ থেকে একটু আড়ালে সময়কে ধারণ করতে করতে গাঢ় হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতার রং। মেঘলা দিনের ভিজে নরম আলোর মতো সে ভাষার অস্তিত্বে আছে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ। কী উপমায়, কী ভাষা-চিত্রকল্প ও রঙের মাধুর্যে কোথাও কোনো উচ্চকিত স্বর ও স্লোগান নেই। একটা সর্বজনীন ভাষা প্রার্থনায় দিশাহারা সময়ের স্বপ্ন ও শোকার্ত-শোষিত বাংলাকে উজ্জীবিত রেখেছে কবির কবিতা। জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতার পাঠককে অনেক সময়জুড়ে আত্মপরিচয়ের এই কবির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে বাংলা কবিতা ‘এক নতুন আরম্ভের’ দেখা পেল। ‘নিজ বাসভূমে’ এবং ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে এই আরম্ভের বিকাশ ও পূর্ণতা পেল।
খুব সরাসরি না হলেও ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ এবং ‘উদ্ভট উটের পিঠে চড়েছে স্বদেশ’-এর স্বরূপ ও বিরূপতার পটভূমি চিহ্নিত করে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সমাজে একটা সদূরপ্রসারী স্বপ্ন ও শান্তি দিয়েছে কবির কবিতা। সমকালের প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন কবি। সেসব কবিতা পড়ে তত্ত্বরুচি-নির্বিশেষে সবাই অধিকারসচেতন কল্যাণমুখী নতুন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানি শোষণের দিনগুলোতেই অল্পে অল্পে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলেন নতুন শামসুর রাহমান। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু, জতির পিতায় ভূষিত হননি। কিন্তু কারাগারে অন্তরীণ তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করে লিখেছেন ‘টেলেমেকাস’ কবিতাটি।
১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করল। তিনি তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত। চাকরির মায়া ত্যাগ করে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন কবি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাবনা প্রকাশ করলে বিক্ষুব্ধ কবি লিখলেন “নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়। /মমতা নামের প্রতি প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়/ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে/শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন/তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,/অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,/ঘুরেছি কাননে তা নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই/ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। আজন্ম আমার সাথী তুমি,/আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,/তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে/আমারই বন্দরে। ’ (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা) ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারিতে গুলিস্তানের একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চিরায়ত কবিতাটি লেখেন। ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি পড়লেই মনে হয় এসে গেছে নতুন সময়। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়। /বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়/বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট/উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে। /ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চুড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে, চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়। /আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। ’
সমকাল, দেশ, মানুষ ও ভূমির অনিবার্য আয়োজনে কবিতার এক ‘শুদ্ধ সত্তা’র খোঁজ পেয়েছিলেন কবি। নিত্যপরিচিত কাব্যতত্ত্বে এই কবিতার জাত ও শ্রেণি নির্ধারণ করা যাবে না। শামসুর রাহমান সময়ের তাজা কবিতা লিখেছেন। মূলত কোনো দশকেই আটকে থাকেনি কবির বোধ ও ভাষা। নিরন্তর চলমান সময়ের দিকেই জাগ্রত রেখেছেন কবির ধ্যান ও কল্পনাপরিসর। কবির বেশির ভাগ কবিতাই সময় ও জীবন থেকে নেওয়া। তাঁর ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর কলমে অনায়াসে উঠে এসেছে সময় ও মানচিত্র প্রসঙ্গ। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘গেরিলা’, ‘তুমি বলেছিলে’, ‘এখানে দরোজা ছিল’ এ রকম উজ্জ্বল ভাষার দীপ্তি ও ফোয়ারা ঢুকে গিয়েছিল বাংলা কবিতায়। সময়কে আবিষ্কার করার এবং জীবন্ত ভাষায় নিংড়ে দিয়ে বাংলা কবিতায় তিনি কৃষ্ণচূড়ার আভা রেখে গেছেন। বাংলা কবিতার চিরাচরিত ভাষাপদ্ধতিকে দুমড়েমুচড়ে এ যেন কলজে ছিঁড়ে বের হয়ে আসা নতুন সময়ের নিনাদ।
নিজস্ব সাহিত্যরুচির অভিজ্ঞানে ৭৭ বছরের জীবনে শামসুর রাহমান বাংলাদেশকেই লিখেছেন। জীবন ও শিল্পের মধ্যে প্রভেদ না রেখে অনিবার্য স্বচ্ছ-শান্ত কণ্ঠে মরিয়া সময়কে কবিতায় ঢেলে দিয়ে প্রবহমান বাংলা কবিতায় নিজের একটা জেনারেশন তৈরি করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় চিৎকার নেই; মাটিগন্ধে সময়ের নিবিষ্ট উচ্চারণে কবিতায় তিনি সত্য ও বাস্তবতা, শান্তি ও স্বপ্ন ঢেলেছেন। ত্রিশীয় ব্যক্তিগত, অন্তর্মুখী প্রবণতায় তিনি ঝুঁকে থাকেননি। কবি কখনোই রাজনৈতিক চেহারায় ঢুকে যাননি। দেশের জন্য যা কিছু সত্য, অপরিহার্য—তাই লিখেছেন। মজলুম আদিব হয়ে কবিতায় তিনি বেঁচে থাকার পৃথিবীকে সন্ধান করেছেন।
চোখ বেঁধে রাখা সময়কে টের পাওয়া যায় শামসুর রাহমানের কবিতায়। তাঁর কবিতায় অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগ নেই। গ্লানিকর একেকটা বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে কবি মানুষের পক্ষে দুঃখিনী বর্ণমালা লিখেছেন। ভাষার নাগরিক নতুনত্বে এবং নতুন বক্তবের সঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক সুরের ঐকতান কবির কবিতাকে অনন্য করেছে। পুরান ঢাকার মহল্লার বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষারূপকে ভিত্তি করে কবির যে কাব্যযাত্রা শুরু হয়েছিল সে ভাষাকেই কালের রেখায় বাংলা কবিতার মূলধারার ঐতিহ্য ও প্রবণতা সমৃদ্ধ করেছে।
সময় ও প্রাসঙ্গিকতার মগ্নপথ থেকে উঠে এসেছেন শামসুর রাহমান। একটা পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট, নাগরিক ভাষার ভেতরে বসবাস করেও বাংলা কবিতার ঐতিহ্য পথেই ছিল কবির গমনাগমন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চলমান ভাবাবেগ ও অন্তর্মুখী নির্জনতার যে রেওয়াজ প্রবাহিত ছিল, সেই পথে ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ সূত্রপথ সম্প্রসারিত ও জনমুখী করে কবি দমকা হাওয়ার মতো নতুন কবিতায় প্রবেশ করলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের দ্রোহী-পুরুষ হয়ে যে কাব্যভাষা নির্মাণ করলেন, সে ভাষায়ই সম্প্রসারিত হলো বাংলাদেশের কবিতা। পূর্ব বাংলার দ্রোহী জীবনের তৎপরতায়, গণমানুষের স্বর ও ‘রোদ্র করোটিতে’ সাম্য ও সৌন্দর্যের নিবিড় যথার্থতায় তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে কাব্যভাষা। কাব্যগ্রন্থের নামকরণ থেকে কবিতার সহজ শব্দগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় কবিধর্ম ও শিল্পের তাৎপর্য।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ।
(কৃতজ্ঞতা: কালের কন্ঠ)