পৃথিবীর যে বিচিত্র সংরাগে, যে আলোর মধুরিমা উৎসবে কবি বৃত হয়েছিলেন, তার কত মধুগন্ধী স্মৃতির অমৃতমূর্ছনা আজো শোনা যায়!
মৃত্তিকাতলচারী জীবনের হাসি -কান্না, প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তি, মিলন- বিরহ, দুঃখ -বেদনাসহ প্রাণ- প্রেরণার নতুন অভিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি নির্জন সত্য হয়ে এসব বাড়ির পরতে -পরতে কথা বলছে!
ফুলের গন্ধে,
বর্ষার বাতাসে,
নিঝুম নিরল বিষাদ হাওয়ায়।
শান্তিনিকেতনের সাথে রবীন্দ্রনাথের সখ্য প্রায় ৭০ বছরের। বাল্য, যৌবন,প্রৌঢ়, বার্ধক্যে কবির আন্তর -জীবনের বিচিত্র কথার গুঞ্জরণ এখানে শোনা যায়।
এখানেই কত কত বছর কবি শব্দের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেছেন ভূমি থেকে ভূমায় ।
রূপ থেকে অরূপে ।
আহা! বাড়িরাবুঝি কবির একা মুহূর্তের নিঃশব্দ স্বরলিপি!
নীরব অথচ সরব এসব বাড়ি মনোযোগযোগ্যতায় অবিরল কাছে টানে।
কান পাতলেই শোনা যায় কত আবেগি উচ্চারণ!
দিগন্তস্পর্শী মধুরতা তখন নিবিড় দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।
মন কেমনের সুদূরতা লালমাটি আর নিসর্গ- ক্যানভাসে আঁকে আনন্দের চন্দ্রকলা!
সুরম্য বিষাদ!
বাতাস কাঁদানিয়া বাঁশির সুরে মন ভেসে যায় দূরে
বহু দূরে।
বুঝি তেপান্তরের মাঠে!
নিবিড় বেদনার পুলকে তখন বাদল ঝরে অঝোর!
‘উদয়ন ‘বাড়ির স্রষ্টা কবি- পুত্র রথীন্দ্রনাথ আর রোগশয্যায় নিবেদিতপ্রাণ সেবক সুরেন্দ্রনাথ কর।
স্থাপত্য-শৈলীরসাথে শিল্পকলার মণিকাঞ্চনযুক্ত দৃষ্টিনন্দন এ বাড়ির অন্দরসজ্জাসহ উদ্যান পরিকল্পনায় রথীন্দ্রনাথ- পত্নী প্রতিমা দেবীর সুরুচির স্নিগ্ধতা আলো হয়ে আছে ।
বিভিন্নদিকথেকেই বাড়িটি বিশিষ্টতাজ্ঞাপক ।
কবির জীবনকালে শেষ মুদ্রিত কাব্য ‘জন্মদিনে ‘এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত শেষ রচনা ‘শেষলেখা’র সিংহভাগ কবিতার জন্ম ‘উদয়ন’ এ।
অপরিমেয় আনন্দ -বৈভব, অতলান্ত বিষাদ , বহুধা বিভাজিত জীবননদীর চিত্র বিচিত্র ঢেউ, কত বিশ্ব ব্যাপারিক ঘটনায় উদ্বেগ, নিবিড় অস্মিতার অঙ্গরাগ এসব কিছু নিয়েই শান্তিনিকেতনের সাথে রবীন্দ্রনাথের বন্ধন সুদীর্ঘ কালের । এ বন্ধন বুঝি সুরের!
বুঝি সীমা থেকে অসীমের অমৃতময়তার!
সেসব কথা জানে পরিব্রাজক মেঘেরা, লাল মাটির উদাস পথ, নিমগ্ন নৈঃশব্দ্য, শালবনের আকুলতা।
আর জানে এইসব বাড়ি, তথা শান্তিনিকেতন ।
হলুদ, সাদাবাড়ির নাম ‘পূনশ্চ ‘। দেয়াল মাটির । ছাদ কনক্রিটের । কবি এখানে ভেষজ আর হোমিও চর্চা করতেন ।
শুধু হলুদ রঙের বাড়ির নাম ‘কোণার্ক ‘। এ বাড়িতে মুদ্রণ কাজ, নানারকম বাদ্যযন্ত্রের সমাহারসহ শিল্পকলার চিত্র-বিচিত্র উৎসারণ আজো বুঝি আঙিনার ঝুমকোলতা ফুলে ফুলে স্মৃতির জোছনা ছড়ায়!
মেটে আর কালো রঙের বাড়িটি মাটির তৈরি। এ বাড়িতে কবি গ্রীষ্মকালে থাকতেন । নাম ‘ শ্যামলী ‘।
হলুদ ফিরোজা রঙের বাড়ির নাম ‘উদীচী ।’ এ বাড়ি থেকেই অসুস্থ কবিকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় । তৎকালীন ই আই রেলওয়ে অধিকর্তা এন.সি. ঘোষ কবির জন্য একটা সেলুনগাড়ির ব্যবস্থা করে দেন ।
সাধারণ দর্শনার্থীসহ দেশি-বিদেশি কত বিশিষ্ট অতিথিরা শান্তিনিকেতনে এসেছেন । এসেছেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম কিশোরমাণিক্য, কনগ্রেস রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু ।
একাধিকবার এসেছেন প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে গুজরাটি শব্দ হরতাল এর প্রবর্তক গান্ধীজী । যাকে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেন ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একবার সাথে এনেছিলেন ১৩ বছর বয়সে যাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন সেই স্ত্রী কস্তুরী বাঈকে । রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গান্ধীজীকে মালার অলংকারে বরণ করেছিলেন।
তখন কত উৎসব- সংবর্ধনা ইত্যাদি ইত্যাদি ।
শান্তিনিকেতন যেন চির উৎসবের লীলা নিকেতন। কত বসন্ত উৎসব, দোল উৎসব, নবান্ন উৎসব, মাঘ উৎসব, বর্ষা উৎসব, হল কর্ষণ উৎসবসহ চিত্তগ্রাহী কত কত মধুরিমা আয়োজনের অপরূপ রূপকথারা আজও হাতছানি দেয় ভেজা বনের বিজনে,
মৃদুভাষী নদীর জলতরঙ্গ সুরে!
কবি: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]