রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনের সব সংসদ সদস্যের (এমপি) আয় বেড়েছে গত পাঁচ বছরে। কারও কারও ব্যাংকে টাকা বেড়েছে অস্বাভাবিক। আবারও কেউ কেউ প্রচুর পরিমাণে জমি কিনেছেন। ছয় এমপির মধ্যে সবারই ব্যাংকের পরিধি বেড়েছে। একজনের অবশ্য হাতের নগদ টাকা কমেছে। তবে তারও বেড়েছে ব্যাংকের টাকার পরিমাণ।
রাজশাহীর এই ছয় এমপির মধ্যে তিনজন এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তারপরও তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকার বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে নেমেছেন। প্রত্যেকেরই মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে বৈধতা পেয়েছে। এসব প্রার্থীদের হলফনামায় তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স ও অন্যান্য সম্পদ বেড়ে যাওয়ার চিত্র দেখা গেছে।
রাজশাহী-১
পাঁচ বছর আগেও রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসেবে কোনো টাকা ছিল না। এখন তাঁর ব্যাংকে রয়েছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৬ টাকা। পাঁচ বছরেই সরকারদলীয় এই সংসদ সদস্যের ব্যাংক হিসাব এভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। পাঁচ বছরে সম্পদশালী হয়েছেন এমপি ফারুকের ওপর নির্ভরশীল সন্তানেরাও।
ওমর ফারুক চৌধুরী ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার এ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ তাঁকে এ আসনের দলীয় প্রার্থী করেছে। এ জন্য তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে হলফনামা জমা দিয়েছেন। হলফনামা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। যাচাই-বাছাইয়ে ফারুক চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে।
ফারুক চৌধুরীর হলফনামায় দেখা গেছে, তার হাতে এখন নগদ আছে ৮৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬৬৬ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ৯০ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টাকা। এর আগে ২০১৩ সালে ছিল মাত্র ৬২ হাজার ৪৫০ এবং ২০০৮ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৫০ টাকা। ২০০৮ সালে ব্যাংকে ৩০ লাখ টাকা থাকলেও ২০১৮ সালের মধ্যে তা শূন্যে নেমে আসে। তবে এখন ব্যাংকে আছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। আগে কিছু না থাকলেও এখন তাঁর বন্ড আছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকার। আরও কয়েক কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন তিনি।
ফারুক চৌধুরী বরাবরই নিজের নামে ৭০ বিঘা কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়ে এসেছেন। নির্ভরশীলদের কোনো জমি ছিল না। এবার তার নির্ভরশীলদের নামেও আছে ৬০ বিঘা জমি। ২০১৮ সালে নির্ভরশীলদের নামে কোনো সম্পদ না থাকলেও এখন আছে নগদ ২৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৬ টাকা, ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বন্ড, ১৭ লাখ টাকার দুটি গাড়ি ও ৮০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে, কৃষিখাত থেকে ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ এবং অন্যান্য খাত থেকে ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৬৬৬ টাকা।
রাজশাহী-২
পাঁচ বছরে ব্যাংকের টাকা বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০০৮ সাল থেকে তিনি এ আসনের এমপি। এবারও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাদশা তার ব্যাংক হিসাবে দেখিয়েছিলেন ২৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ টাকা। এখন তার ব্যাংকে আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ২৪৫ টাকা। আগে সাড়ে ১৬ লাখ ও ৩৮ লাখ টাকার দুটি গাড়ি থাকলেও এখন একটি জিপের দামই ৭০ লাখ।
পাঁচ বছর আগে ফজলে হোসেন বাদশার হাতে নগদ ছিল ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৬ টাকা। এখন আছে ২৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের মালিক হয়েছেন তিনি। আগে দোকান ভাড়া থেকে কোনো আয় না থাকলেও এখন মার্কেট ভাড়া থেকে বছরে আয় দেখিয়েছেন ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮২৩ টাকা। তিনি এমপি হিসেবে বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা সম্মানি ও ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮৩ টাকা আয় দেখিয়েছেন।
রাজশাহী-৩
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন গত পাঁচ বছরে এলাকায় ৭৫ বিঘা জমিই কিনেছেন। তিনি ২০১৪ সালে প্রথমবার ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার এখানকার এমপি নির্বাচিত হন। এবার মনোনয়ন পাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
হলফনামায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ও ২০১৮ সালে তার নামে চার লাখ টাকা দামের দুই বিঘা জমি ছিল। এখন তার নামে জমির পরিমাণ ৭৭ বিঘা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরেই তিনি ৭৫ বিঘা জমি কিনেছেন। আয়েন এই জমির মূল্য দেখিয়েছেন ৩ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার ৩২৬ টাকা। এবার তিনি ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮০ টাকায় রাজধানীর পূর্বাচলে তিন কাঠার একটি প্লটও নিয়েছেন। ২০১৩ সালে স্ত্রীর নামে কোন ফ্ল্যাট ছিল না। ২০১৮ সালে ৩০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট হয়। এবার স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট দেখানো হয়েছে প্রায় ৮৬ লাখ টাকার।
অথচ ২০১৩ সালে স্ত্রীর হাতে নগদ ছিল মাত্র ১ লাখ টাকা। ব্যাংকে কিছুই ছিল না। এখন শিক্ষক স্ত্রীর হাতেই নগদ আছে ১৮ লাখ ২৯ হাজার ৯১৯ টাকা। সঞ্চয়পত্র আছে ১০ লাখ টাকার। আয়েন তার আয়ের খাত হিসেবে এমপি হিসেবে সম্মানী ছাড়াও দেখিয়েছেন মাছচাষ। তিনি ৭৭ একর জমি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেন বলে হলফনামায় আছে। এ খাত থেকে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১১ লাখ। হাতে এখন নগদ আছে ৩ লাখ।
রাজশাহী-৪
পাঁচ বছরে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হকের নগদ টাকা কমেছে। তবে বেড়েছে ব্যাংকের টাকার পরিমাণ। এনামুল হক ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার এ আসনের এমপি। তবে এবার মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এবার হলফনামায় এনামুল দেখিয়েছেন, তার হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ২৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় হাতে ছিল ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৮ টাকা। স্ত্রীর ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬৯ টাকা। এখন তার স্ত্রীর হাতে আছে ৩ লাখ টাকা। তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ব্যাংকের টাকা বেড়েছে।
২০১৮ সালে এনামুলের ব্যাংকে ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ১১৪ টাকা, স্ত্রীর ছিল ৪ লাখ ২ হাজার ৩২৫ টাকা। এখন এনামুলের ব্যাংকে আছে ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংকে আছে ৩২ লাখ ১০ হাজার ৪৪ টাকা। এনামুল ও তার স্ত্রীর আগের মতোই বন্ড আছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার ও ৭ কোটি ৬৭ লাখ ১০ হাজার টাকার। ব্যবসাখাতে এনামুলের বিপুল বিনিয়োগ এবং আয় রয়েছে।
রাজশাহী-৫
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের এমপি ডা. মনসুর রহমান পাঁচ বছরে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ডা. মনসুর ২০১৮ সালে প্রথমবার এমপি হন। এবার মনোনয়ন পাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হলফনামায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৭ গুণ। ব্যাংকে গড়ে উঠেছে টাকার পাহাড়।
শিক্ষকতা, শেয়ার ও চাকরি থেকে মনসুর রহমান তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১৪ লাখ ৯ হাজার ৯৬১ টাকা। এখন তার বার্ষিক আয় ৯২ লাখ ৭০ হাজার ২৮৯ টাকা। এখন কৃষিখাত থেকেই আয় ২৭ লাখ, ভাড়া আদায় ৮৪ হাজার, ব্যবসা থেকে ৬ লাখ ৬০ হাজার, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র থেকে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩৪ টাকা, চাকরি থেকে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫৩ টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে বছরে আসে ৩৮ লাখ টাকা। এই টাকার খাত নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
মনসুরের হাতে এখন নগদ আছে ১ লাখ ৯ হাজার ১৬২ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৪ টাকা। ব্যাংকে ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ১২৪ টাকা। এখন ব্যাংকে আছে ২ কোটি ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ১৭৬ টাকা। আগে সঞ্চয়পত্র ছিল ৩৫ লাখ টাকার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৭ টাকা। মনসুরের আগে ঋণ ছিল ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৬১ টাকা। ঋণের পরিমাণ এখন কমে ৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৮ টাকায় নেমে এসেছে।
আগে স্থাবর সম্পদ হিসেবে মনসুরের ৩০ লাখ টাকার জমি ছিল। এবার তার নামে সাড়ে ৩২ বিঘা কৃষিজমি ও ৬ বিঘা পুকুর দেখানো হয়েছে। এই জমি ও পুকুরের মূল্য দেখানো হয়নি।
রাজশাহী-৬
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের এমপি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে আড়াইগুণের বেশি। তিনিও ২০০৮ সাল থেকে এ আসনের এমপি। এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০১৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৩ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৮ টাকা। এখন তা আড়াইগুণেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ৭ কোটি ৯২ লাখ ৯১ হাজার ২৫৪ টাকা। হাতে নগদ টাকাও বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ২০১৮ সালে নগদ ছিল ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৯ হাজার ৭০৬ টাকা। এখন আছে ২১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ১৫৩ টাকা।
শাহরিয়ার আলমের শেয়ার আছে ৬৬ কোটি ৪১ লাখ ৩২ হাজার ৭০০ টাকার। আগে শেয়ার ছিল ৫৮ কোটি ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০ টাকার। আগে সঞ্চয়পত্র ছিল ১০ লাখ, এখন ৩০ লাখ। পাঁচ বছর আগে শাহরিয়ারের গাড়ির দাম ছিল ৭৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৫ টাকা। এখন লাক্সারী কারের দাম ১ কোটি ১০ লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা। ২০০৮ সালে শাহরিয়ার যখন প্রথমবার এমপি হন, তখন তার হাতে নগদ টাকা ছিল ১ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৫ টাকা। ব্যাংকে ছিল মাত্র ৪ হাজার ১৩৬ টাকা। ২০১৩ সালের নির্বাচনের সময় ব্যাংকে কোন টাকাই ছিল না নিজের নামে। এখন স্ত্রী-সন্তানদের নামেও বিপুল সম্পদ রয়েছে। শিল্পপতি শাহরিয়ার আলম কোম্পানির শেয়ার, কৃষিখাত, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পাওয়া সম্মানী ও দোকান এবং অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়াকে নিজের আয়ের উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন।
হলফনামার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী, ডা. মনসুর রহমান ও ফজলে হোসেন বাদশাকে ফোন করা হলেও তারা ধরেননি। তাই তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পাঁচ বছরে ৭৫ বিঘা জমি কেনা প্রসঙ্গে এমপি আয়েন উদ্দিন বলেছেন, ২০১৮ সালেও জমি ছিল। পৈত্রিক সম্পত্তি পরে ভাগ হয়েছে। কিছু জমি কিনেছেনও। অবৈধ কোন সম্পদ নেই। সব সম্পদের আয়কর রিটার্ন দেখানো আছে।