আমাদের কতিপয় রাজনীতিবিদরা মজার মানুষ! আপনাদের কথা শুনতে ব্যাপক মজা লাগে! সব সময় এভাবে মজা দিয়ে যাবেন। ক্ষমতায় থাকেন, না থাকেন, মজা দিতেই হবে। রাজনীতিবিদরা (সবাই নয়) যদি রাজনীতির ‘ধান্দাবাজি’ না করে কমেডি অভিনয়ে আসতেন খুব ভালো হতো। বাংলাদেশের কতিপয় রাজনীতিবিদরা যেনো বিনোদনের ‘ডিব্বা’। দিলদার, বাবা হাসমত, হার’ন কিচিঞ্জার, এটিএম শামসুজ্জামান, টেলিসামাদের রিয়েল নমুনা!
ডিজিটাল থেকে স্মার্ট। ইতিপূর্বের ‘খেলা হবে’ স্লোগান পেছনে ফেলে সামনে এসেছে ক্রিকেট খেলার নানা মারপ্যাঁচের ডেলিভারি। বর্তমানে গুগলি যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরের সময় দুই বেগমের (শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া) লড়াই নিয়ে বিদেশি মিডিয়াগুলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো। ইকোনমিস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, মিরোরসহ বিশ্বের খ্যাতনামা মিডিয়াগুলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর শিরোনামে তখন থাকতো ‘টু ব্যাটলিং বেগমস’।
গত কয়েকদিনেও বাংলাদেশের রাজনীতির অভিধানে কিছু নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, তা হলো- গুগলি, বোল্ড আউট, নক আউট, মিডল স্টাম্প ইত্যাদি। ‘আমরা এমনভাবে গুগলি দিয়েছি যে আওয়ামী লীগ বোল্ড হয়ে গেছে: ফখরুল।’ ‘গুগলি তো করেছেন, কিন্তু বল তো নো বল: কাদের।’ ‘বিএনপি নিজেই বোল্ড আউট হয়ে গেছে: হাছান মাহমুদ।’ ‘আপনাদেরকে নো বলে কিংবা এলবিডব্লিউ দিয়ে আউট করব না; বরং মিডল স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে পতন ঘটানো হবে: রিজভী।’ কথাগুলো বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে বাক্যবাণের প্যাটার্ন।
তাদের টোপিকে আমাদের রিলাইজেশন এরকম যে, বোলিং টিমের (মির্জা ফখরুল আলমগীর) হাত ঘুরিয়ে লেগ স্পিন/ গুগলি করছেন। সেই বল খেলতে গিয়ে (ড. হাছান মাহমুদ) বোল্ড হলেও পরক্ষণেই অপর পক্ষের ব্যাটম্যান হেসে হেসে আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছেন, দেখো, দেখো ‘নো বল’। ওদিকে কভারে দাঁড়ানো পেস বোলার (রুহুল কবির রিজভী) আনলিমিট টেম্পারে বলছেন, হাতে বলটা পাই, সামনের ওভারেই ব্যাটারের স্টাম্প উড়িয়ে দেব। অন্যদিকে প্যাভিলিয়ন থেকে ব্যাটিং দলের খেলোয়াড় (ওবায়দুল কাদের) চিৎকার করে বলছেন, ‘খেলা হবে! খেলা হবে!’
রাজনৈতিক সচেতন প্রায় সকলেই জানেন, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সাহেব ঘোষণা করেছিলেন, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানো হবে। তার হাতে ‘ট্রাম্প কার্ড’ রয়েছে। এই ট্রাম্প কার্ড কী তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। এটি এখনো রহস্যাবৃত। তবে ৩০ এপ্রিলে সরকারের পতন ঘটেনি। ট্রাম্প কার্ড তত্ত্বের জন্য আব্দুল জলিল সাহেব দলের অভ্যন্তরে ও বাইরে সমালোচিত হয়েছিলেন। প্রয়াত আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিলের ট্রাম্প কার্ড যেভাবে রাজনীতির মাঠে তুমুল ঝড় তুলেছিল, এ সময়েও বড় দু’দলের নেতৃবৃন্দ ‘গুগলি’ নিয়ে মাঠে উত্তাপ অ্যারাগন্ট্ ছড়াচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের কেউ বলছেন- ‘গুগলি’ বল করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে ‘আউট’ করে দেবেন। অন্যদল পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গুগলি নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই বলে দাবি করছেন। কারণ, ব্যাটিং দলের নেতাদের দাবি, গুগলি হলেও প্রতিপক্ষ দল ‘নো বল’ করেছে। ফলে আউট হওয়ার সুযোগই নেই।
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রাস্তায় চূড়ান্ত সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, সম্ভাব্য বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নিয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আতঙ্ক ও আশঙ্কা তত বেশি বাড়ছে। আমরা বলতে চাই, খেলাধুলার মতো একটি ইনোসেন্ট বা বিশুদ্ধ বিনোদনের মধ্যে রাজনীতির মতো ‘নোংরা, কলুষিত’ ব্যাপার মেশানো ঠিক নয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউ আমাদের কাছে অপরিক্ষীত নয়। সবার ক্ষমতাকালীন সময় আমরা দেখেছি। সুষ্ঠু সহিংসতামুক্ত নির্বাচন সকলেই চায়, সকল দলই চায়। কিন্তু বিষয়টি হলো, যখন যে দলই ক্ষমতার বাইরে থাকে কেবল তারাই চায়। সুতরাং সিনিয়র নেতাদের রাজনীতির মাঠকে খেলার মাঠ বানানো ক্রিড়াপ্রেমিক কেউ ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
রাজনীতিবিদরা আসলে ইশারা-ইঙ্গিতে ক্রিকেটের ‘বল’ বলতে অনেকটা বল (শক্তি) প্রয়োগ করার জন্য এসব বলছেন। এগুলো অর্বাচীন কথাবার্তা। মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ জাতীয় নির্বাচন খেলা তামাশার বিষয় নয়। জাতীয় নির্বাচন সিরিয়াস ইস্যু।
তারা যদি সত্যিই খেলোয়াড়ি চেতনা ব্যতীত (নির্বাচনী মাঠে) ব্যাট বল হাতে মাঠে (প্রতিহিংসাপরায়ন মনোভাবে) নেমে হাত ঘুরিয়ে বল করতে গিয়ে অথবা সপাটে ব্যাট চালাতে গিয়ে কাঁধে, কোমরে, বাহুতে চোট পান, কিংবা ঝাঁপিয়ে বল ধরতে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেললেন, তাহলে তো ‘নো বল’ হলেও সমস্যা কী? ফকরুল সাহেব যে গুগলি করতে পানের এটা তো প্রতিপক্ষ বুঝতে পেরেছেন। তাই সাবধান হওয়া জরুরি, বোল্ড হয়েও যেতে পারেন। নো বলে রান আউট করা যায়, পরে রিভিউ নেওয়ার মতো সিচুয়েশন থাকতে হবে। যুগপৎ আন্দোলন হলে, তখন হয়তো স্ট্যাম্প দেখে বোলিং হবে না, বোলিং হবে এলোপাথারী। দৌড়ে বাঁচতে না পারলে (জনগণের রোষানলে পড়লে) রান আউট হতে হবে। লেগ স্টাম্প যখন উড়ে যাবে তখন থার্ড আম্পায়ার ডেকেও লাভ হবেনা। বলটা ‘নো’ না ‘রাইট’, না ‘ওয়াইড’ এটা কে ঠিক করবে? এ জন্য একজন নিরপেক্ষ আম্পায়ার দরকার। ‘ইন্তেকাল কমিশনের’ মতো আম্পায়ার পক্ষ হয়ে নো বল দিলেও রিভিউ বোলারের পক্ষে গেলে আউট। এটা ভুলে গিয়ে মনের আনন্দে রান নেওয়ার জন্য বেশি দৌড়াদৌড়ি না করাই ভাল, কারণ নো বলে কিন্তু রান আউট আছে।
বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাসীনরা তাদের যখন বোলিংয়ে রেখেছে, তখন বিষয় হলো, বোলার কখনো আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেনা। আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে ব্যাটম্যান; সুতরাং ওবায়দুল কাদের আউট হলেও অন্য কেউ ব্যাট হাতে ক্রিজে ইন! অন্য কথায় ব্যাটিং দলের খেলোয়াড়রা এতো শিওরিটি কীভাবে? স্পিন বোলারদের তো স্বাভাবিকভাবে নো বোল হয় না, তার মানে আম্পায়াররাও আপনাদের কমিউনিটির মধ্যে? ২০১৪, ২০১৮ সালের বল হয়তো ‘নো বল’ ছিল, ২০২৩ সালেরটা ইন্টারন্যাশনাল কোটায় আছে। নো বলের সুযোগ নেয়া যথেষ্ট ইজি নয়। আর যদি ওয়াইড বলে ছক্কা হয় তাহলে কি হবে? ব্যাটম্যানরা দৌড়াতে পারবেন তো? নো বলে কিন্তু রান আউট হয়। বেশি লোভ করতে যেয়ে (২০১৪, ২০১৮ সালের পরও) আরেকটি রান অতিরিক্ত নিতে গিয়ে রান আউটের পসিবিলিটি শতভাগ।
নো বল গুগলি হতে পারে, ইন সুইংগার হতে পারে বা আউট সুয়ংগার হতে পারে বা বাউঞ্চার হতে পারে তথা বোল্ড আউট বা কট আউট বা লেগ বিফোর উইকেট আউট না হলেও রান আউট হতে পারে। তাছাড়া ওভারে একটা বল নো বল হলেও আরো ৬টা বল থেকেই যায়, নো বল যতগুলো হউক না কেন ওভারের ছয়টা বল থেকেই যায় তথা একটা লেজিটিমেড বলই যথেষ্ট ব্যাটারকে আউট করতে। প্রয়োজন হলে বিসিবিকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।
নির্বাচনী খেলায় দুই পক্ষই একে অপরকে হুংকার দিচ্ছেন। বর্তমানে দেশের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে এক অজানা শঙ্কায়। যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন সর্বসাধারণ। বিএনপি এবং বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ যদি অনঢ় থাকে, তাহলে দেশে কি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে না? যদি হয় তাহলে সেই সংকটের পরিণতি কী হবে? কেননা কোনো দল যদি ছাড় না দিয়ে নিজের জায়গায় স্থির থাকে, তাহলে আদৌ সংঘাত এড়ানো যাবে কী? আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচনী সমস্যার সমাধানে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে?
স্বাধীনতার ৫২ বছরের পর, ২০০৭-০৮ সালের সামরিকসমর্থিত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের ২ বছর ছাড়া গণতন্ত্রে ফেরার গত ৩২ বছরে আওয়ামী লীগ প্রায় ২০ বছর, বিএনপি ১০ বছর দেশ শাসন করেছে। দেশ সেবায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে দুদল কার্যত শত্রুতে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা আওয়ামী লীগ-বিএনপি সম্পর্ক সম্পূর্ণ বদলে যায়। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকাই রাজনীতির চূড়ান্ত ও একমাত্র রূপে পরিণত হয়।
বর্তমানে নির্বাচনই একমাত্র গুগলি। এ ছাড়া আর অন্য কোন পথ নেই। সময়ও নেই। আমরা বলবো, রাজনীতিবিদরা গুগলি-ফুগলি বাদ দিয়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিয়ে এগিয়ে আসুন। চাকরিজীবী, পথচারী, দিনআনে দিন খায় শ্রমজীবী, অসুস্থ রোগী, দোকানদদার, রিকশাওয়ালাদের কস্ট দিবেন না। মাঠও আমাদের রেফারিও আমাদের বাঁশি-বুশি যা দিবে আমাদের পক্ষেই দিবে। আগামী নির্বাচন যেনো এরকম না হয়, আসেন, বসেন, চা খান, চিনি নেই চলে যান!
লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান। ইমেইল: abunoman1972@gmail.com