রোজা ফারসি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে দিন। যেহেতু এই আমলটি দিনের শুরু থেকে শেষাংশ পর্যন্ত পালন করা হয় তাই একে রোজা বলা হয়। আর আরবিতে এর নাম সাওম(صُومَ)। যার শাব্দিক অর্থ কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায়- সুবেহ সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলা হয়।
রোজার হুকুমঃ
দ্বিতীয় হিজরীতে রোজা ফরজ হয়। ইসলামের পাঁচটি রুকনের মধ্যে রমজান মাসের রোজার স্থান হলো তৃতীয়- যা প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের ওপর ফরজ। এর অস্বীকারকারী কাফের এবং বিনা কারণে পরিত্যাগকারী ফাসেক। যেমন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিতঃ (১) সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল (২) রীতি মত নামায কায়েম করা (৩) যাকাত দেয়া (৪) রমযানের রোজা পালন করা (৫) বায়তুল্লাহয় হজ্জ করা। (বুখারী ও মুসলিম)
রোজার সময়ঃ
আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন,
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُوا
الصِّيَامَ إِلَى الَّيْلِ
অর্থঃ আর তোমরা খাও এবং পান কর, যে পর্যন্ত কালো সূতা থেকে সাদা সূতা প্রকাশিত না হয়। অর্থাৎ ফজরের শুভ্রতা (সুবহে সাদিক) সুস্পষ্ট না হয়। অতঃপর রোজাকে তোমরা রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর। (সূরা বাকারাঃ ১৮৭) যখন পূর্ব দিক থেকে রাত আগমন করবে এবং পশ্চিমাকাশে দিন লুকিয়ে যাবে ও সূর্য অস্তমিত হবে, তখনই রোজাদার ইফতার করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন এই দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) রাত আগমণ করবে এবং এই দিকে (পশ্চিম দিকে) দিন লোপ পাবে, তখন অবশ্যই রোজাদার ইফতার করে নিবে। (বুখারী ও মুসলিম)
রোজার নিয়্যত ও এ সংক্রান্ত মাসয়ালা
রোজার নিয়্যত: রোজার দিনের পূর্ব রাতে নিয়্যত করলে বলবে,
نَوَيْتُ أَنْ أَصُومَ غَدًا مِنْ شَهْرٍ رَمَضَانَ الْمُبَارَكَ فَرْضًا لَكَ يَا أَللهُ فَتَقَبَّلُ مِن إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ
العَلِيمُ
(নাওয়াইতু আন আসূমা গাদাম মিন শাহরি রামাজানাল মুবারাক, ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু!
ফাতাক্বাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সমীয়ুল আলীম।) অর্থাৎ, হে আল্লাহ আমি তোমার জন্য আগামীকাল ফরজ রোজা রাখার নিয়্যত করলাম। তুমি আমার রোজা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত।
রোজারদিন জোহরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে নিয়্যত করলে বলবে,
نَوَيْتُ أَصُومَ هَذَا الْيَوْمَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ فَرْضِ رَمَضَانَ.
(নাওয়াইতু আসূমা হাজাল ইয়াওমা লিল্লাহি আজ্জা ওয়া জাল্লা মিন ফারদ্বি রামাজান।) অথবা, আমি আজ আল্লাহ তায়া’লার জন্য রমজান মাসের ফরজ রোজার ইচ্ছা করলাম । (বাহারে শরীয়ত, রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা:- রমজানের প্রতিটি রোজার জন্য আলাদা নিয়্যত করতে হবে। নিয়্যত ব্যতিত রোজা শুদ্ধ হবেনা। যদিও রোজাদার সুস্থ, মুক্বীম কিংবা জ্ঞানসম্পন্ন হয়। নিয়্যত ব্যতিত রোজা রাখলে তার ওপর ক্বাজা দেয়া আবশ্যক। (রদ্দুল মুহতার, দুররে মুখতার, জাওহারা, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা:- রমজানের শুরুতেই বা যেকোনদিন যদি পুরা রমজান মাসের সব রোজার নিয়্যত করে এটা শুধু যেদিন নিয়্যত করেছিল সেদিনের রোজার জন্য কার্যকর হবে, অন্যান্য রোজা গুলোর জন্য আলাদা আলাদা নিয়্যত করতে হবে। (জাওহারা, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা – রোজার জন্য রাতে শুধু এই নিয়ত করে নেয়াই যথেষ্ট যে, আমি আগামীকাল রোজা রাখব কিংবা দিনে (জোহরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে) এই নিয়ত করাই যথেষ্ট যে, আজ রোজা রাখব।
মালয়ালা:-আরবিতে নিয়্যত করা জরুরি নয়;বরং যেকোনো ভাষাতেই নিয়ত করলে শুদ্ধ হবে। তবে আরবীতে নিয়্যত করা উত্তম।
মাসয়ালা -নিয়্যত মুখে উচ্চারণ করা উত্তম। তবে মনে মনে নিয়্যত করলেও শুদ্ধ হবে ।
(বাহারে শরীয়ত) মাসয়ালা – অপবিত্র অবস্থায় রোজার নিয়্যত করা জায়েয, তবে ফজরের নামাযের আগে গোসল করবেন।
মাসয়ালা:- যে ব্যক্তি রোজার নিয়্যত করার পর বেহুশ হয়ে যায়, এ অবস্থায় ইফতারের সময় হয়ে গেলে তবে তার রোজা হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা:-মুক্বীম ব্যক্তি (যে নিজ বাসস্থানে অবস্থান করে) যদি রমজান মাসে ফরজ রোজার নিয়্যত না করে শুধু রোজা রাখার নিয়্যত করে; কিংবা রমজানের ফরজ রোজা ব্যতিত অন্য রোজার (যেমন, মান্নত, আশুরা, নফল ইত্যাদি রোজার) নিয়্যত করলেও রমজানের ফরজ রোজাই আদায় হবে । (রদ্দুল মুহতার, দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়ত)
রমজানের রোজা এবং রমজানের কাজা রোজার জন্য স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন নাই; বরং রোজা রাখতে সক্ষম হলে, তার (স্বামীর) নিষেধ সত্ত্বেও রোজা রাখা আবশ্যক। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত)
সাহরী খাওয়া ও এ সংক্রান্ত মাসয়ালা:
সাহরি খাওয়ার ফজিলত ও নিয়ম:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, আমাদের ও আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী-খ্রীস্টানদের) সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (মুসলিম শরীফ)। ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানরা রোজা রাখে। কিন্তু তারা সাহরি খায়না। এজন্য উম্মাতে মুহাম্মাদীদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সাহুরী খেয়ে রোজা রাখতে বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, তোমরা সাহরি খাও। কারণ এতে বরকত রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম) সাহরি খাওয়াতে বরকত থাকার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। কারণ এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের অনুসরণ করা হয় এবং সাহরি খাওয়াতে রোজাদার সারা দিন শক্তিশালী থাকে।
সাহরি সংক্রান্ত মাসয়ালা
মালয়ালা:-সেহরী খাওয়া সুন্নাত এবং এর অনেক ফজিলত ও রয়েছে । তাই ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও কিছু পরিমানে খাবার খাওয়া উত্তম ।
মাসয়ালা – ফজরের সামান্য পূর্বে অর্থাৎ দেরি করে সেহরী খাওয়া হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
তায়া’লা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত।
মাসয়ালা:-কেউ প্রবল নিদ্রার কারণে ঘুম থেকে উঠতে না পারলে শুধু নিয়্যত করেই রোজা রেখে দেবে । সেহরী না খেলে রোজা তরক করতে পারবেনা।
মাসয়ালা:-পেট পুরে সাহরি খাওয়া জরুরি নয়, দুই বা এক লোকমা কিংবা দু’চার দানা খেলেও যথেষ্ট ।
মাসয়ালা : সাহরী খাওয়ার সময় আযান পড়লে মুখের খাবার তৎক্ষণাৎ ছুড়ে ফেলতে হবে।
যদি কোন কারণে খাবার পেটের ভিতর ঢুকে যায়, তাহলে রমজান পরবর্তীদিনে কাজা রোজা রেখে তা পূরণ করতে হবে। মাসয়ালা:-রাতে গোসল ফরজ হয়েছে, সেহরির সময়ও শেষ, এমতাবসস্থায় গোসল না করে সেহরি খেয়ে রোজা রাখলে রোজা নষ্ট হবেনা। তবে সেহরি খেয়ে যত দ্রুত সম্ভব পবিত্রতা
অর্জন করতে হবে নতুবা নাপাক থাকার কারণে গুনাহগার হবে ।
মাসয়ালা:- যদি সাহরি খেতে বিলম্ব হয়ে যায় এবং প্রবল ধারণা হয় যে, ভোর হওয়ার পর কিছু পানাহার করেছে, তবে এ অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার ত্যাগ করা এবং পরে ওই রোজা কাজা করা ওয়াজিব।
মাসয়ালা-ভোর হয়ে যাওয়ার পরও ভোর হয়নি মনে করে রোজাদার ব্যক্তি সাহরি খেতে থাকলে অন্যজন তা দেখলে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। তবে রোজাদার যদি অত্যন্ত দূর্বল হয় তবে খানা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্মরণ করিয়ে না দেয়াই উত্তম। এটি দূর্বল রোজাদারের প্রতি আল্লাহ তায়ালার দয়া হিসাবে নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার,বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা:-রাত বাকি আছে মনে করে সেহরি খাওয়ার পর দেখা গেল রাত ঠিকই বাকি আছে অথবা কিছু বুঝা গেলনা, তাহলে (ক্বাজা কাফফারা) কিছুই ওয়াজিব হবেনা। আর যদি জানতে পারে যে, সেহরির সময় শেষ হয়ে গেছে তাহলে শুধু ক্বাজা দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা:-সেহরির সময় শেষ হয়ে গেছে মনে করে সাহরি খাওয়ার পর যদি জানতে পারে যে, ঠিকই সাহরির সময় শেষ হয়ে গেছে, তাহলে শুধু ক্বাজা ওয়াজিব হবে। আর যদি কিছুই জানতে না পারে তাহলে (ক্বাজা কাফফারা) কিছুই ওয়াজিব হবেনা। (রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা:-সাহরির ক্ষেত্রে মোরগের ডাক গ্রহণযোগ্য নয়। (রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত ইফতার সংক্রান্ত মাসয়ালা-মাসায়েল:
ইফতারের নিয়্যত:
ইফতার করার আগে এই দোয়া পড়বেন:
الَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّحِمِينَ.
আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন ।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রোজা রেখেছি, তোমারই প্রদত্ত রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।
মাসয়ালা:-ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ ফেরত দেওয়া হয়না। (ইবনে মাজাহ)
ইফতারের একটু আগে বসে দরুদ পড়া ও দোয়া করা মুস্তাহাব।
মাসয়ালা:-সূর্য ডুবার সাথে সাথে বিলম্ব না করে ইফতার করা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত। দেরীতে ইফতার করা ইয়াহুদী-খ্রীস্টানদের অভ্যাস। তারা আকাশের তারকা প্রকাশিত হওয়ার জন্য বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তাই মুসলমানদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পরই ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের ভিতর থাকবে, যত দিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারী)
মাসয়ালা – আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সাবধানতার জন্য ইফতারে কিছু সময় বিলম্ব করা উত্তম। (রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত
মাসয়ালা – মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করা সুন্নাত। হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
মাসয়ালা:-রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত ছিল। খেজুর দিয়ে ইফতার করা। আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিবের নামায পড়ার আগে কয়েকটি রুতাব (পাকা খেজুর) দিয়ে ইফতার করতেন। পাকা খেজুর না থাকলে ইফতারের সময় শুকনা খেজুর খেতেন। আর তা না থাকলে সামান্য পানি দিয়ে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
মোটকথা, খেজুর কিংবা খোরমা দ্বারা ইফতার করা সুন্নত। তা না হলে অন্য কোনে মিষ্টিদ্রব্য
বা শুধু পানি দ্বারা ইফতার করবে। মাসয়ালা – আগুনে পাকানো খাদ্য, রুটি, ভাত, শিরনি ইত্যাদি দ্বারা ইফতার করা দূষণীয় নয়। কিন্তু ফল দ্বারা ইফতার করাই উত্তম।
মাসয়ালা:-ইফতার শেষ করে এই দু’আ পাঠ করবেঃ ذَهَبَ العلم وابتلتِ العُروقُ وَ لَيْتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ الله
অর্থঃ পিপাসা দূরীভূত হয়েছে, শিরাসমূহ শীতল হয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছায় বিনিময়ও নির্ধারিত হবে। (আবু দাউদ)
মাসয়ালা:-সূর্য ডুবে গেছে মনে করে ইফতার করার পর যদি জানতে পারে যে, সূর্য ডুবে নাই, তাহলে শুধু ক্বাজা ওয়াজিব হবে। আর যদি জানতে পারে যে, সূর্য ডুবে গেছে অথবা যদি (সূর্য ডুবেছে কি ডুবে নাই) কিছুই জানতে না পারে তাহলে (ক্বাজা কাফফারা) কিছুই ওয়াজিব হবেনা।আর যদি সন্দেহে থাকে তাহলে শুধু কাজা দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা – অন্য রোজাদারকে ইফতার করালে রোজার ছাওয়াব পাওয়া যায়।
যাদের উপর রোজা ফরজঃ
প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, বালেগ, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, সামর্থ্যবান ও নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী মুসলিম ব্যক্তির ওপর পবিত্র রমজান মাসের রোজা বা সিয়াম পালন করা ফরজ।
যাদের উপর রোজা ফরজ নয়:-
(১) কাফের
(২) সফর অবস্থায় (মসাফির)
(৩) গর্ভবতী মহিলা
(৪) দুগ্ধ দানকারিনী মহিলা
(৫) অসুস্থ ব্যক্তি,
(৬) ঋতুকালীন তথা হাযের-নেফাস স সংসপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় বা নিরুপায়
(৭) বিবেকহীনতা (পাগল)
(৮) জিহাদ
(৯) বৃদ্ধ বা অপারগ ব্যক্তি। (দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়াত)
মাসয়ালা:- কোন ব্যক্তি যদি উল্লিখিত ওযরগুলির কোন একটি বহাল থাকাবস্থায় মারা যায় এবং এতটুকু সময় পেলনা যে, ক্বাজা আদায় করবে; তার ওপর ফিদয়া দেয়ার ওয়াসিয়ত করা আবশ্যক নয়। তা সত্ত্বেও ওয়াসিয়ত করলে তা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ থেকে কার্যকর করা হবে। আর কাজা আদায় করার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ক্বাজা আদায় না করলে; তার ওপর ফিদয়া দেয়ার ওয়াসিয়ত করা আবশ্যক। ইচ্ছাকৃত
রোজা না রাখলে তো ফিদয়া দেয়ার ওয়াসিয়ত করা আরো বেশি আবশ্যক। ওয়াসিয়ত না করা সত্ত্বেও তার উত্তরাধিকারীরা যদি ফিদয়া আদায় করে তার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা:- কেবল ঐসব রোজার জন্য ফিদয়ার ওয়াসিয়ত করা ওয়াজিব যেগুলো রাখতে সক্ষম ছিলেন। যেমন, দশটি রোজা কাজা হয়েছে, ওযর চলে যাওয়ার পর, তার মধ্যে পাচটি রোজা রাখতে সক্ষম ছিল, এরপর মারা গেছেন। তাহলে এই পাঁচটির ওয়াসিয়ত করা ওয়াজিব। (দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালাঃ– মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ থেকে ওয়াসিয়ত তখন কার্যকর হবে, যখন মৃতব্যক্তির ওয়ারিশ থাকবে। আর যদি ওয়ারিশ না থাকে এবং ওয়াসিয়ত পূর্ণ করতে যদি সমস্ত সম্পত্তি খরচ করতে হয়, তাহলে সমস্ত সম্পত্তি খরচ করা আবশ্যক। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা:- মৃতব্যক্তির ওয়ারিশ যদি শুধু স্বামী বা স্ত্রী হয় তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বের করে নেয়ার পর তাদের অংশ দেয়া হবে এবং এরপর অবশিষ্ট যা থাকবে তা (সম্পূর্ণ) যদি ফিদয়ার জন্য খরচ করতে হয়, খরচ করবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, বাহারে শরীয়ত)
চিকিৎসার কারণে রোজার হুকুম।
মাসয়ালা:-বাইরে থেকে রোজাবস্থায় যে কোন প্রকারে বা পদ্ধতিতে শরীরের ভিতর (খানা বা ঔষধ) কিছু প্রবেশ করলে, যদি তা পাকস্থলী অথবা মগজে প্রবেশ করে, তবে অবশ্যই রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা – রোজাবস্থায় ইঞ্জেকশন ইনহেলার (Inhelar), ইনফিউশন (গ্লুকোজ,
ডেক্সট্রোজ স্যালাইন, টিকা (Vaccine), চেতনানাশক ( Anaesthesia) গ্রহণে অবশ্যই রোজা ভেঙ্গে যাবে।
মাসয়ালা:-যা নাক, কান, পায়খানার রাস্তা ইত্যাদি দ্বারা মগজ অথবা পেটে পৌঁছবে,
তাতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (বাদায়ে সানাঈ)
মাসয়ালা:- কানে তেল গেলে রোজা ভাঙ্গবে, পানি গেলে রোজা ভাঙ্গবেনা। মগজ বা পেটে প্রবেশ করুক আর না করুক।
মাসয়ালা:- যদি চোখে সুরমা দেয়, তবে রোজা ভঙ্গ হবে না, কেননা চোখ হতে মগজ পর্যন্ত রাস্তা নেই। (হিদায়)
মাসয়ালা :- রোজাবস্থায় এক্সরে করালে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। তেমনি ত্বকের অসুখের ক্ষেত্রে অনেক সময় UV-Exposure দেয়া হয়, এতেও রোজার কোন ক্ষতি হবে না।
মাসয়ালা:- রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া (Blood Transfusion): রোজা রেখে রক্ত গ্রহণ করলে অবশ্যই রোজা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হয় না। আর কোনো রোগীকে রক্ত দেয়ার কারণে যদি এত দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে যে শেষ পর্যন্ত। রোজা রাখার ক্ষমতাই থাকবে না তাহলে সে ক্ষেত্রে রোজা অবস্থায় রক্ত দেয়া মাকরূহ।
মাসয়ালা:-আকুপাংচারে ও আল্ট্রাসনোগ্রাম (Ultrasonogram) পদ্ধতিতে রোজা নষ্ট হবেনা।
মালয়ালা:- এন্ডোস্কপি (Endoscopy) এন্ডোস্কপিতে একটি নল বা পাইপ পেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ভিতরের অবস্থা দেখা হয়। সুতরাং নলটি যদি পাকস্থলী স্পর্শ করে, তবে রোজা ভঙ্গ হবে কিন্তু নলটি যদি পাকস্থলী স্পর্শ করার পূর্বে বের করে আনা হয়, তবে রোজা ভঙ্গ হবে না।
মাসয়ালা-নাক-কান ছিদ্র করাঃ রোজাবস্থায় কেউ যদি গহনা পরিধানের জন্য নাক, কান ছিদ্র করে, তবে রক্ত বের হলেও রোজা ভঙ্গ হবে না কিন্তু তাতে যদি মলম লাগানো হয়। ( Ointment যেগুলোতে ঔষধ রয়েছে), তবে রোজা ভঙ্গ হবে।
মাসয়ালা -দাত তোলা (Teeth Extraction): রোজা রেখে, লোকাল এনেসথেসিয়া ছাড়া দাঁত তুললে রোজা ভঙ্গ হবে না, কিন্তু লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে দাঁত তুললে রোজা ভঙ্গ হবে। দাত তোলার যেকোন পদ্ধতিতে যদি কিছু পরিমাণ রক্ত ভিতরে যায় রোজা ভঙ্গ হবে।
মাসয়ালা:- ইনসুলিন গ্রহণঃ এমন অনেক রোগী আছেন, যারা রোজা না রাখার মতো অসুস্থ নন কিন্তু রোজা রাখার সামর্থ্য্য থাকলেও ঔষধ গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। যেমন- ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন। সেক্ষেত্রে ইনসুলিন গ্রহণের সময়সীমা পরিবর্তন করে সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু রোজা রেখে ইনসুলিন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে।
মাসয়ালা:- রেডিও থেরাপী প্রয়োগে রোজার কোন ক্ষতি হবে না।
মাসয়ালা – মেডিসিনাল প্যাচ (Medicinal Patch) যেমন, বুকের ব্যাথায় আইসোসরবাইড ডাই-নাইট্রেট প্যাচ, বাতের ব্যাথায় ব্যালাডোনা প্লাস্টার (Belladonna Plaster), এ সকল প্যাচ ব্যবহারে রক্তে ওষুধের শোষণ ঘটে। তাই যদি জানা যায়, কোন প্যাচ ব্যবহারে রক্তে ওষুধের শোষণ ঘটে, তবে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু যদি জানা যায় রক্তে ওষুধের শোষণ ঘটে না তাহলে রোজা ভাঙ্গবে না । কিন্তু মূলতঃ প্যাচ এ কারণেই দেয়া হয়, যাতে ধীরে ধীরে রক্তে ওষুধের শোষণ ঘটে।
মাসয়ালা – যদি জানা যায়, কোন স্প্রে ব্যবহারে ঔষধ রক্তে পৌঁছে তবে সে ধরণের স্প্রে ব্যবহারে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু যে সকল স্প্রে ব্যবহারে রক্তে উপস্থিতি পাওয়া যাবেনা, সেরকম স্প্রে ব্যবহারে রোজার কোন ক্ষতি হবে না।
রোজার কাজা:
মাসয়ালা – যে সমস্ত কারণে রোজা কাজা করা ওয়াজিব হয়, সেই ক্ষেত্রে একটি রোজার জন্য একটি রোজা রাখাই যথেষ্ট। (দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়ত)
মাসয়ালা-কাজা রোজার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী নয়। এজন্য কাজা রোজা জিম্মায় থাকাবস্থায় যদি নফল রোজা আদায় করে তা আদায় হয়ে যাবে।কিন্তু পরবর্তী রামজান আসার আগেই যে কোন সময় আদায় করে নিবে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যার ওপর পূর্ববর্তী রোজার ক্বাজা অনাদায়ী রয়েছে আর তা আদায় করলনা, তার এ রমজানের রোজা কবুল হবেনা। তবে পরবর্তী রামাজান আসার আগে যদি কোন কারণে কাজা রোজা আদায় করতে না পারে এবং ইত্যবসরে রমজানমাস উপস্থিত হয় তাহলে প্রথমে বর্তমান রমজান মাসের রোজা রাখবে এবং রমজান পরবর্তী সুবিধামত সময়ে পূর্ববর্তী কাজারোজা আদায় করে দেবে। (দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়ত)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের মাসয়ালা-মাসায়েল গুলো যথাযথভাবে নিজেদের জীবনে বেশি বেশি আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: হাফেজ মাওলানা আবু সায়েম মুহাম্মদ কাইয়ুম ফারুকী। প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
খতিব: বায়তুন নুর জামে মসজিদ।, ১৭ নং ওয়ার্ড,পশ্চিম বাকলিয়া,সৈয়দ শাহ রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম।