রঙিন স্মৃতির সাদা-কালো গল্প

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

স্কুল স্মৃতি মানে সাদা-খাকি স্কুল ড্রেস, সকালে অ্যাসেম্বলি। ক্লাসে পড়া না পাড়ার অজুহাত। স্কুল স্মৃতি মানে টিফিন সময়ের অপেক্ষা, সহপাঠীদের সাথে দৌড়ঝাঁপ, ঝগড়ার ছলে দুষ্টুমি। সহপাঠী ও স্যার-আপাদের বিশেষ কিছু নাম। স্কুল স্মৃতি মানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান, অতঃপর টেস্ট পরীক্ষা, বিদায় অনুষ্ঠান, এসএসসি পরীক্ষা। এমন হাজারো রঙিন স্মৃতির সাদা-কালো গল্প।

ঊনিশ শ বিরানব্বই সালে স্কুল পার করে এসেছি। তারপরও সেসব স্মৃতি আমার জীবনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। আমার স্কুলের কথা মনে পড়লে মাঝে মাঝে মনে হয় কেন যে স্কুল জীবন শেষ হলো। ওই জীবনটাই তো ভালো ছিল।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

আমি পড়তাম গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই স্কুলে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে এসে আমি যেনো এক বড় জগৎ দেখতে পেলাম। প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশ অস্বস্তিকর মনে হতো। তবে ধীরে ধীরে সেটা আমার বাড়ির মতো আপন হয়ে উঠল। শিক্ষক আর বন্ধুদের স্নেহ-ভালোবাসায় আমার স্কুল জীবন হয়ে উঠেছিল আনন্দের ও গৌরবময়।

আমার স্কুলে নিয়মিত অ্যাসেম্বলি হতো। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির সকল ছাত্রছাত্রী অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত থাকতেন। নিয়মিত শপথ পাঠ, কোরআন তেলাওয়াত, জাতীয় সংগীত হতো। সে এক মধুর স্মৃতি।

সকাল বেলায় গেট দিয়ে ঢুকেই তড়িঘড়ি বই-খাতা ক্লাসে রেখে ছোট থেকে বড়, উচ্চতা অনুসারে ক্লাস ভেদে অ্যাসেম্বলির লাইনে দাঁড়ানো। আমি থাকতাম লাইনের শুরুর মাঝেই, সামনে পিছনে হরহামেশা টিকলু, তপন, মোরশেদ, মন্টু, কামাল, মিঠু, আবু সাঈদ..। কোনো দিন একমিনিট দেরি হলেই সর্বনাশ, গেট বন্ধ হয়ে যেত। সেদিন আর অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণের সুযোগ হতো না।

জাতীয় সংগীত গাওয়া আর শপথ করা নিয়ে কি যে কান্ড হতো? জাতীয় সংগীত শুরু হলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সামনের জনের শরীরে শুরশুরি দিয়ে আর ডান হাত সামনে ধরে, আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, “মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব, স্বধর্মের প্রতিবিধান মানিয়া চলিব….” ইত্যাদি বলতে বলতে কখন যে হাতটা সামনের জনের কাধে উঠে যেত তা কি আর আমি জানি?

ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের কৃষিবিজ্ঞান ক্লাস নিতেন কেরামত আলী স্যার। স্যারের ক্লাস ছিল অষ্টম পিরিয়ডে। ৪০/৪৫ মিনিটের ক্লাস। কোনো কোনো দিন স্যার পাঁচ-দশ মিনিট আগেই ক্লাসের পড়া শেষ করতেন। যেদিন পড়া আগে শেষ হতো, সেদিন স্যার আমাদের বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমাতে বলতেন। আমরা সবাই ঘুমাতাম। কেউ একটু মাথা উঁচু করলে স্যার অমনি ধমক দিতেন এবং লাঠি দিয়ে ছোট্ট করে পিটুুনি দিতেন। ঘুমানোর আগে স্যার আমাদের এভাবে বলতেন ‘ক্লাস- এখন ঘুমাবে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ো’-আমরা সবাই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমাতাম। আজও আমার কানে ভেসে আসে স্যারের সে-ই কণ্ঠ- ‘ক্লাস-এখন ঘুমাবে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ো’।

আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন মো: সোলায়মান হোসেন স্যার। তিনি আমাদের স্কুলের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও উনার অনেক স্মৃতি আজও মণিকোঠায় ভেসে উঠে। স্যারের চেহারাটা দিব্যি চোখে ভাসে আজো। স্যারকে আমি কখনো ক্লাসে দেরি করে আসতে দেখি নাই। পূর্বের ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই স্যার আমাদের ক্লাসের সামনে এসে উপস্থিত হতেন। ক্লাস থেকে আগের স্যার বের হওয়া মাত্রই সোলায়মান স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়তেন। স্যার আমাদের অংক ক্লাস নিতেন, খুব সহজ করে অংক বুঝাতেন, তাঁর বুঝানোর পদ্ধতি আমার খুব ভালো লাগতো। এখনও মো: দেলোয়র হোসেন স্যার, মাওলানা আবুল কাশেম স্যার, আব্দুল হাই স্যার, কবীর স্যার, তাহেরা আপা, জাহানারা আপা, মিনু আপা, কামরুনন্নাহার আপা, আয়েশা আপা …. স্যার-আপাদের মুখ আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান রয়েছে।

নামকরণ রোগটা বোধকরি কম বেশি সবার-ই আছে। বিশেষ করে বন্ধু মহলে এর প্রসার ব্যাপক। বাপ-দাদার রাখা নাম পলাশ কখন পইল্লা, তপন কখন তইপ্পা হয়ে যায় তা খোদ পলাশ ও তপনও টের পায় না। এমনি অনেক মজার মজার নাম আমাদের স্কুলে তৈরি হতো। আমাদের এক বন্ধু মোরশেদ হয়ে গেল ভমবল মোরশেদ, আনোয়ার পারভেজ ও হয়ে গেল বদ্দা পারভেজ, সবুজ হয়ে গেল কারাগার সবুজ, আবদুল কাদের হয়ে গেল লাল মিয়া। এমন অনেক নাম ছিল আমাদের বন্ধু মহলে। ওদের ওই নামে ডাকলেই রাগে লাল হয়ে এক পর্যায়ে ক্ষেপে যেত। আমরা টিচারদেরও এমন অনেক নাম দিয়েছিলাম। যা শুধু আমাদের ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের কখনো পুরোনাম ধরে ডাকা হত না, সংক্ষিপ্ত রূপে ডাকা হত। আমাদের উর্বর মস্তিস্ক কাজে লাগিয়ে সেসব নামের মর্মার্থ আমরা ঠিক বের করে নিতাম। কেউ জিজ্ঞাসা করল, কার ক্লাস এখন? আমরা নির্বিকারে বলে দিতাম ‘এ কিউব স্যারের’ ক্লাশ। এমন অনেক নাম ছিল স্যারদের। স্কুল জীবনের এসব মজার মজার নামকরণগুলো মনে হলে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাঁসি ফুটে উঠে।

স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবের আয়োজন ছিল আমার জন্য বেশ আনন্দের। সারা বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেদিনটা হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-কোলাহলে কেটে যেত। এ দিনে স্কুলের সেরা ছাত্র ও নানা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হত। তেমন কিছু স্মৃতি আমার আজও চোখে ভাসে। স্কুলের সেরা স্পোর্টসম্যান হিসেবে মাহবুব ভাই ও জহির ভাই সকলের মাঝে পরিচিত ছিলেন। ওনারা সহোদর। প্রতিটি ইভেন্টে উনারা দুই ভাই ফার্স্ট হতেন এবং স্কুলের সেরা খেলোয়ারের পুরস্কার জিতে নিতেন। স্কুলের সেরা ছাত্রের পুরস্কার জিতে নিতেন ’৯১ ব্যাচের মোজাম্মেল ভাই। একজন আদর্শ ছাত্র বলতে যা বুঝানো হয়, সবগুলো গুণেই তিনি গুণান্বিত ছিলেন।

দপ্তরি আলী ভাই এর কথা না বললে তো লেখাটা কেমন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। খাটো গড়নের মানুষটা, স্বাস্থ্য ভালো, স্কুলের পাশেই একটি দোকান ঘর ছিল তাঁর। পরিবারসহ বসবাস করতেন। উনার দোকানের সিংগারার কথা মনে পড়ে, বেশ মজার সিংগারা বানাতেন, টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা তাঁর দোকানের সিংগারা কিনে খেতো, ওনার সিংগারা খায় নাই এমন ছাত্রছাত্রী মেলা ভার। আজও আলী ভাইয়ের সিংগারার স্বাদ মুখে লেগে আছে।

ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে হাটিহাটি পা পা করে দশম শ্রেণি। কীভাবে যে কেটে গেল পাঁচটি বছর। এসএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষা। অতঃপর বিদায় অনুষ্ঠান। সবশেষ এসএসসি পরীক্ষা। যথারীতি ফল প্রকাশ। স্কুল জীবন শেষে কলেজ জীবন।

জীবনের এতগুলো বছর পার করার পরও, ফেলে আসা স্কুল জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়। খুব মিস করি সহপাঠী আর সেই ক্লাসরুম, স্কুল মাঠ, প্রিয় বন্ধু ও শিক্ষকদের।

 

লেখক: মোনবী আলম,  সাংবাদিক।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net