যেভাবে মেক্সিকো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে চীনা পণ্য

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৭ মাস আগে
ছবি: সংগৃহীত

বিলাসবহুল ও আরামদায়ক সব চামড়ার সোফা, যেগুলো মন্টেরের ম্যান ওয়াহ ফার্নিচার ফ্যাক্টরি থেকে তৈরি হয় সেগুলো শতভাগই ‘মেড ইন মেক্সিকো’। এখান থেকে তাদের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট ও কস্টকোর মত বড় বড় সব বিপণিতে। কিন্তু এই কোম্পানিটি চীনের মালিকানাধীন এবং মেক্সিকোতে উৎপাদন কারখানাও তৈরি হয়েছে চীনা অর্থে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মেক্সিকোর মধ্যকার এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক একটা নতুন শব্দে পরিচিত হয়ে উঠেছে মেক্সিকোতে।

সেটা ‘নিয়ারশোরিং’ – অফশোরিংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে এমন নাম। ‘ম্যান ওয়াহ’ বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানির মধ্যে একটা, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর মেক্সিকোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এসে অবস্থান নিয়েছে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের কাছাকাছি এসে পণ্য উৎপাদন করা।

এতে পরিবহন খরচ কমে যাওয়া ছাড়াও চূড়ান্ত যে পণ্য প্রস্তুত হলো তা বিক্রির ক্ষেত্রে পুরোপুরি মেক্সিকান।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধে ওয়াশিংটন চীনা কম্পানিগুলোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ও কর আরোপ করেছে সেটা এড়ানোও সম্ভব হয়। বিশাল এই কারখানা ঘুরে দেখানোর সময় ম্যান ওয়াহর জেনারেল ম্যানেজার ইয়ু কেন ওয়েই বলেন, অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক্যাল দিক চিন্তা করেই তারা মেক্সিকোতে তাদের কোম্পানি সরিয়ে এনেছেন।

পরিষ্কার স্প্যানিশ উচ্চারণে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে আরো তিনগুণ, এমনকি চারগুণ উৎপাদনের আশা করছি।” তিনি আরো বলেন, “মেক্সিকোতে আমাদের আসার উদ্দেশ্য ভিয়েতনামে আমরা যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করি, সেই পরিমাণ পণ্য এখানে উৎপন্ন করা।”

২০২২ সালে কম্পানিটি মন্টেরে আসে এবং এরই মধ্যে মেক্সিকোতে ৪৫০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে তারা। জেনারেল ম্যানেজার আরো বলেন, তাদের লক্ষ্য ১২’শ ওপর কর্মীকে কাজে লাগানো। এতে সামনের বছরগুলোতে কয়েক ধাপের অপারেশন এখানে চালু করা যায়। তিনি বলেন, ‘মেক্সিকোর মানুষ খুবই পরিশ্রমী এবং দ্রুত শিখতে পারে। আমাদের খুবই ভালো সব অপারেটর আছে এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেশি। তাই শ্রমিকের দিক থেকে আমি মনে করি মেক্সিকো কৌশলগতভাবেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

নিয়ারশোরিং মেক্সিকান অর্থনীতিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। গত বছরের জুন পর্যন্ত মেক্সিকোর মোট রপ্তানির আগের বছরের থেকে ৫.৮ শতাংশ বেড়ে যায়, যেটার অর্থমূল্য প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর তা কমার কোনও লক্ষণ নেই। এ বছরের প্রথম দুই মাসেই মেক্সিকোতে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে তা ২০২০ সালের মোট বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেকের সমান।

ম্যান ওয়াহ ফ্যাক্টরির অবস্থান মন্টেরের বাইরে চাইনিজ-মেক্সিকান ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হফুসানে। এখানে প্লটের চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। শুধু তাই নয়, মেক্সিকোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক অ্যাসোসিয়েশন (এএমপিআইপি) জানাচ্ছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেক্সিকোর সকল সাইট এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মেক্সিকো খুব সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় চীনকে তাদের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার বানিয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মেক্সিকোর কিছু অংশে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পেছনে দ্বিতীয় আরেকটা নিয়ারশোরিং আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রও মেক্সিকোতে কারখানা স্থাপন করছে, যার মধ্যে কিছু কিছু এশিয়া থেকে সরিয়ে আনছে তারা।

পরিণতি নিয়ে সংশয়
যেভাবে চীনা বিনিয়োগ আসছে তাতে অনেকেই মেক্সিকোকে সতর্ক হতে বলেছেন। কারণ ভূরাজনৈতিকভাবে এতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে যেতে পারে মেক্সিকো। ন্যাশনাল অটোনমাস ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকোর সেন্টার ফর চায়না-মেক্সিকো স্টাডিজের অধ্যাপক এনরিক দুসেল বলেন, “শহরের পুরনো ধনী যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা দেখা যাচ্ছে, শহরের নতুন ধনী চীনের সঙ্গে। কিন্তু মেক্সিকোর আগের সরকার বা বর্তমান সরকারেরও কোন কৌশল দেখা যাচ্ছে না এই নতুন ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের ব্যাপারে।”

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তাতে সামনে নতুন রাজনৈতিক ইস্যুও আসতে পারে। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে যেই আসুক, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্কে খুব একটা উন্নতি হবে বলে কেউ মনে করছেন না। অধ্যাপক এনরিক দুসেল মনে করেন, নিয়ারশোরিংকে বরং ‘নিরাপত্তা অফশোরিং’ বলা যেতে পারে। কারণ ওয়াশিংটন চীনের সঙ্গে সম্পর্কে অন্য সব কিছুর ওপরে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। তার যুক্তি মেক্সিকো এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

দুসেল আরো বলেন, “এই উত্তেজনার মাঝেও মেক্সিকো যেন চীনের জন্য একটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘ওয়েলকাম টু মেক্সিকো’। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর পরিণতিটা যে ভালো হবে না, তা বুঝতে আপনার ডক্টরেট করার দরকার নেই।”