ম্যাক্রোঁর সফরে বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্কে যোগ হবে নতুন পালক

:: উজাইর ইসলাম ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের পরপরই ঢাকা সফর করবেন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের এটি ২য় বাংলাদেশ সফর। এসব সফরে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।

এদিন তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন এবং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

পরদিন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করবেন। এ দিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগ করবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকে স্মরণীয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের সব দিককে আরও জোরদার করাই এই সফরের লক্ষ্য। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স কৌশলগত দিকনির্দেশনার জন্য চলমান রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহের ইঙ্গিত দিয়েছে। দুই দেশ রাজনীতি ও কূটনীতি, নিরাপত্তা ও সামরিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়সহ সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে কথা বলবে। আলোচনার মূল বিষয় হবে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে দুই দেশের ব্যবহারিক ও টেকসই সহযোগিতাকীভাবে উন্নত করা যায়।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে তাদের সহযোগিতা আরও বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করবে। দুই দেশ তাদের প্রশিক্ষণ সহযোগিতা অব্যাহত রেখে এবং তাদের সংলাপ জোরদার করার মাধ্যমে এই বিষয়ে প্রচুর জোর দিচ্ছে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হবে। ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সুরক্ষিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য একটি অভিন্ন অবস্থান নির্ধারণ করা দুই দেশের মধ্যে আলোচনার সময় বিশেষ গুরুত্ব পাবে।

চলতি বছরের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার উন্নয়নশীল সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তারা পারস্পরিক লাভজনক ও কৌশলগত সহযোগিতার দিকে আরও এগিয়ে গেছে।

ফ্রান্সের মতে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরও শক্তিশালী কৌশলগত নিরাপত্তা থাকা দরকার। জাতি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলির সাথে সম্পর্কের উন্নতিতে মনোনিবেশ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।

বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি লাভজনক স্থানে পরিণত হয়েছে। ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ দেশগুলোর অর্থনীতির একটি হলো বাংলাদেশ। তবুও বাংলাদেশের নীতিমালায় উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি বিনিয়োগ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফ্রান্স বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়াতে পারে।

২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যকার ৫১ বছরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবসান ঘটে। উভয় দেশই গত ৫১ বছরে অসাধারণ আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, অন্যদিকে ফ্রান্স প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বিকাশে বিশ্বনেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। যেহেতু উভয় রাষ্ট্রই আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তাই বর্তমান সময়ে, বিশেষত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি যুগে তাদের এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ তার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ ঘোষণা করেছে, যা অনেকটা ফ্রান্সের মতোই।

বিগত ৫০ বছরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সফরের মাধ্যমে দুই দেশ দীর্ঘদিন ধরে তাদের সম্পর্ক জোরদার করেছে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চুক্তিও করা হয়েছিল, বিশেষত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি (১৯৮৭)। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে ফ্রান্স। সংকটের শুরুতে ফ্রান্স জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ ডেকেছিল।

উন্নত রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও বেড়েছে। ২০২০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ২.৭৬ বিলিয়ন ইউরো ছিল, যার মধ্যে ২৫ মিলিয়ন ইউরো আমদানি করা হয়েছিল এবং ২.৫২ বিলিয়ন ইউরো বাংলাদেশ ফ্রান্সে রফতানি করেছিল। বাংলাদেশ মূলত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করে এবং ফ্রান্সে তৈরি পোশাক বিক্রি করে।

ফ্রান্স ও বাংলাদেশ তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করে। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতি মিত্রান্দের বাংলাদেশ সফরের সাথে সাথে এই সহযোগিতা শুরু হয়। ওই সফরে ফ্রান্স বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পে সহায়তা প্রদান করে। ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি যৌথ উদ্যোগ ও প্রকল্প, যেমন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল প্রজেক্ট এখন বাংলাদেশে চলমান রয়েছে।

ফ্রান্স বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তৈরি করেছে ফরাসি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থ্যালেস। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ বর্তমানে আলোচনার বিষয়। থ্যালেস এখন বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়েও কাজ করছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়েও কথা বলছে দুই দেশ। ফ্রান্সের ড্যাসল্ট এভিয়েশনের কাছ থেকে একটি রাফাল জেট কেনার কথা ভাবছে বাংলাদেশ।

একসাথে কাজ করে ফ্রান্স ও বাংলাদেশ এখনও এই রোগের সঙ্গে লড়াই করছে। মহামারী মোকাবেলায় ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো ঋণ দিয়েছে এবং এ পর্যন্ত ৫.৩৮ মিলিয়ন ডোজ টিকা দান করেছে, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে এমন সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বায়নের এই যুগে গত ৫১ বছরে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বা “আন্তঃসাংস্কৃতিক” সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮৭ সালের সাংস্কৃতিক সহায়তা চুক্তির পর থেকে এই অংশীদারিত্ব ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজে ফরাসি ‘নরম শক্তির’ প্রভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হতে পারে। ফরাসি ভাষা অ্যালিয়াস ফ্রাঁসাইয়ের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। যেহেতু ফরাসি ভাষা জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা, তাই ভাষা শেখার পাশাপাশি অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে অধ্যয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু, তরুণরা ফরাসি দর্শন, সংগীত এবং চলচ্চিত্রের প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে উঠছে।

একই সঙ্গে ফরাসি সমাজে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও বাড়ছে। ফ্রান্সে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আইএনসিআই’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে বৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৪০০ জন। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। প্যারিসে এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। রেমিটেন্স প্রদানের পাশাপাশি ফ্রান্সে কর্মরত বাংলাদেশিরা ফ্রান্সের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পর্কের আন্তরিক প্রকৃতির ভিত্তিতে উভয় দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও প্রসারিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি লাভজনক স্থানে পরিণত হয়েছে। ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ দেশগুলোর অর্থনীতির একটি হলো বাংলাদেশ। তবুও বাংলাদেশের নীতিমালায় উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি বিনিয়োগ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

ফ্রান্স বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে ফ্রান্সের প্রযুক্তিগত দক্ষতা থেকেও লাভবান হবে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখন আলোচনা চলছে। সাম্প্রতিক সফরকালে এক যৌথ ঘোষণায় দুই দেশ লক্ষ্যযুক্ত কারিগরি সহায়তা, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি রফতানি বাড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

উপরন্তু, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে আন্তঃসরকারি সম্পর্কের উন্নতির অনেক সুযোগ রয়েছে। চলমান কোয়াড-চীন সংঘাত এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের আলোকে বাংলাদেশ তার ভৌত অবস্থান এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার অবস্থানের ফলস্বরূপ তাৎপর্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ কখনোই আন্তর্জাতিক বিষয়ে কোনো পক্ষ বেছে নেয়নি, কারণ তারা সবসময় সমতার ধারণাকে সমর্থন করেছে। অন্যদিকে, ফ্রান্স ইতিমধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। দু’দেশের সর্বোত্তম স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল উভয় দেশই চায়। ঐক্যবদ্ধ বিবৃতিতেও এই দাবি জানানো হয়েছে। উভয় দেশ তাদের যৌথ বিবৃতিতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধারণার প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে যা মুক্ত এবং সুরক্ষিত।

অন্যদিকে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিক্ষাক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থী এবং উচ্চ শিক্ষার উচ্চাকাঙ্ক্ষী গবেষকদের জন্য অন্যতম সেরা বিকল্প হ’ল ফ্রান্সের অত্যাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। অতএব, উভয় দেশের বৃত্তি প্রোগ্রাম এবং সহজ ভিসা পদ্ধতি তৈরি করা উচিত। এর ফলে মেধাবী বাংলাদেশিরা ফ্রান্সে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে এবং অত্যাধুনিক তথ্য ও বিজ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারবে। ফলস্বরূপ, উভয় দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বে যোগ দিলে জিএসপি প্লাস কর্মসূচিতে যোগ দিতে ফ্রান্সের সহায়তাও প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের প্রাণবন্ততা বজায় রাখতে জিএসপি প্লাস কর্মসূচি জরুরি।

ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য নগণ্য। যেগুলো আছে সেগুলো দুর্লভ। অতএব, এই অনন্য ৫১ তম বার্ষিকীতে তাদের আন্তরিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি তাদের অভিন্ন ভবিষ্যত লক্ষ্য এবং জাতীয় লক্ষ্যগুলির আলোকে, উভয় দেশের আগামী দিনগুলিতে তাদের অংশীদারিত্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। ফ্রান্স ও বাংলাদেশ উভয়ই এর থেকে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

লেখক: উজাইর ইসলাম, ফ্রিল্যান্স লেখক এবং কলামিস্ট।