সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক মেসেঞ্জারে ভয়ংকর ফাঁদ পাতা বেনজির হোসেনকে (৪০) গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
বেনজির মূলত ফেসবুকে ভুয়া জৌলুসপূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করতেন। এরপর সেই প্রোফাইল ব্যবহার করে তিনি নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করতেন।
প্রথমে প্রেমের ফাঁদ, পরে বিয়ে এবং সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখানো হতো সেই নারীকে। এর জন্য বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন বেনজির। এভাবে বিভিন্ন নারীকে টার্গেট করে বছরের পর বছর প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। এতে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
সম্প্রতি এই এক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করে সাত মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বেনজির। একইভাবে আরেক নারীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছাড়াও বিভিন্ন নারীর কাছ থেকে ৫০টিরও বেশি স্মার্টফোন হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার খুলনার ফুলতলায় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নগদ নাম্বার থেকে ক্যাশ আউটের সময় সন্ধ্যায় হাতেনাতে গ্রেফতার হন তিনি।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
সিটিটি বলছে, প্রতারক বেনজিরের অভিনব প্রতারণার ধরন ছিল অনেকটাই নেটফ্লিক্সের ট্রেন্ডার সুইটলার ডকুমেন্টারি ড্রামার মতো। জেলা পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণা, রোমান্স স্ক্যাম, ইন্স্যুরেন্স স্ক্যাম, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পরিচয়ে প্রতারণা করেছেন তিনি। চাকরির স্ক্যাম, হুন্ডি ব্যবসা, মানবপাচারসহ নানা ধরনের প্রতারণামূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িত বেনজির। তার গ্রামের বাড়ির নড়াইল সদর উপজেলার আঠপাড়া মির্জাপুর গ্রামে। তার বাবার নাম জামির হোসেন।
যেভাবে প্রতারণা করতেন বেনজির
গ্রেফতার বেনজির হোসেন শাহিদ হাসান নামে আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশি বিমান চালকের প্রোফাইল হুবহু কপি করে Shahid Hasan (Pilot Officer) নামে একটি ফেইক ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করেন। ফেসবুক প্রোফাইলটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তিনি নিয়মিত প্রকৃত শাহিদ হাসানের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে বিমান চালানোর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। তিনি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করতেন। শুরুতে সেই নারীকে প্রেমের ফাঁদ, পরে বিয়ের প্রলোভন এবং সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি অডিও কলে তাদের সাথে কথা বললেও নানান অজুহাতে ভিডিও কলে কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন। এরপর অনলাইন বিয়ের এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন সময় বিপদে পড়ার কথা বলতেন। সেই নারীদের কাছে টাকা চাইতেন। তার দেওয়া বিভিন্ন নগদ নাম্বারে (প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা ১৯টি নগদ নাম্বারের বিষয়ে জানা গিয়েছে) ধাপে ধাপে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করতেন। বেনজির হোসেনের প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৩টি নগদ নাম্বারে গত চার মাসে এক কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি৷।
আসাদুজ্জামান জানান, বেনজির হোসেন নড়াইলে নিজের বাড়িতে থেকে প্রতারণার কাজ করলেও ক্যাশ আউট করতেন তার বাড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যশোর ও খুলনার বিভিন্ন নগদ ক্যাশ আউট পয়েন্টে। তার প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম এবং নগদ নাম্বারের রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত এনআইডি অন্য ব্যক্তির নামে। ক্যাশ আউটের সময় বেনজির হোসেন পরিচয় ও চেহারা গোপন করতে ক্যাপ, সানগ্লাস ও মুখে মাস্ক পরে থাকতেন।
প্রতারণা করে সম্পদের পাহাড় বেনজিরের!
মূলত বেনজিরের দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই। কিন্তু এরপরও গত কয়েক বছরে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। কয়েক বছরে প্রতারণার অর্থে পাঁচ বিঘা জমির উপর বাগান বাড়ি (দুটি ডুপ্লেক্স ভবন), আনুমানিক তিন বিঘা জমির উপর সম্প্রতি কেনা বিলাসবহুল ভবন, নড়াইলে বিভিন্ন জায়গায় আনুমানিক ২০ বিঘা মাছের খামার, নড়াইলে বিভিন্ন স্থানে নির্মিতব্য ভবন, যশোর ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন ও বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্সের সন্ধান পাওয়া গেছে।