মেয়েদের সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকলো!

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago
জান্নাতুন নাঈম প্রীতির লেখা ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ ও উৎসর্গ।

জান্নাতুন নাঈম প্রীতির ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি এবারের একুশে বইমেলায় আসার পরই শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে নিজের লেখা বইয়ে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ করা কতটা নৈতিক, কতটা আইনসিদ্ধ, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। বাংলা একাডেমি গঠিত টাস্কফোর্স ইতিমধ্যে বইমেলার বইটি নিষিদ্ধ করেছে।

একটা বিশ বছর বা তার আশপাশের বয়সের মেয়ে দেড়গুণ, দ্বিগুণ বয়সের নানা পর্যায়ের বিবাহিত, অবিবাহিত, বয়োবৃদ্ধ পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাডজাস্টেবল হয়ে একান্তে যা কিছু করেছে, তা প্রকাশ করাকে, নারীবাদ বা সাহসের কর্ম বলে পাবলিসিটি করা কতটুকু যৌক্তিক? না এটা চরম অবক্ষয়ের বহিপ্রকাশ! জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইটি আমি পড়িনি, রুচিও নেই। তবে যারা পড়েছেন তাদের থেকে জানার সাথে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা বেশ কয়েকটি রিভিউ পড়েছি। এছাড়া লেখিকার ফেইস বুক আইডিতে এ্যাক্টিভিটিসদের কমান্ড/রিকমান্ড দেখেছি, যাতে মনে হয়েছে এটা কোন দিক থেকেই বই মনে হয় না। লেখায় কারো নাম উল্লেখ না করে আমি ইঙ্গিতে অনেকেরই প্রসঙ্গ এনেছি। যারা পড়ছেন, কারোরই বুঝতে অসুবিধা হবে না। কারণ, পয়েন্টিংকৃত পাকলিক ফিগারগুলো কারো অজানা, অচেনা নয়।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটিতে লেখিকার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিয়ে বেশি কিছু নেই। তবে সম্পূর্ণ অপ্রসঙ্গিত ও অনৈতিক যোনিসম্ভূত কারবারের বহু ইতিবৃত্ততে ভরপুর। প্রীতি বইটি আÍজীবনী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেউ তার আÍজীবনী লিখতে গিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত জীবনের কাসুন্দি ঘাটার কতটুকু অধিকার রাখে? আÍজীবনীতে নিজের কথা থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমি অমুকের সাথে বেডশেয়ার করেছি এটা লিখলে তবু মানা যায়। কিন্তু যদি লেখা হয়, আমি অমুকের সাথে শুয়েছি, অমুক বলেছে যে সে তমুকের সাথেও… এটা মানা যায় কী? ‘তমুক’ ব্যক্তি প্রীতির আÍজীবনীতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক নয় কী? বইটি না আÍজীবনী, না ভ্রমণকাহিনী, না সাহিত্য, চিত্রকলা, যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয়, না আর্ট-লিটারেচার অ্যাপ্রিসিয়েশনের। তবে এতোটুকু বলা যায়, শিরোনাম হিসেবে তা চটকদার!

অনেকে এটাকে নারীবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সাহিত্যকর্ম বলেও অভিহিত করেছেন। কারো সাথে বেডশেয়ারিংয়ের গল্প আবার সাহিত্য হয় কীভাবে? আমি যা ইচ্ছা তাই করব, একে স্বাধীনতা বলে না। এর সঙ্গে দায়িত্বশীলতা প্রাসঙ্গিক। লেখক হিসেবে প্রীতির দায়িত্বশীলতা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। সেক্সক্লিপ ফাঁস করার মেন্টালিটি সম্পন্ন লেখা সাহিত্যকর্মের লেভেলে পরে কী? যারা সাহিত্য শিখেন এবং পড়েন তাদের কাছে আর্বজনা বলেই বিবেচিত হবে।

লেখাগুলো আÍজীবনী বা সাহিত্যকর্ম না বলে সাহিত্যের নামে যৌনতা, নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার আছে এ অজুহাতে, যা লেখা হয়েছে তাকে ‘যৌনসাহিত্য’ বলা যেতে পারে। আসলে একজন প্রকৃত লেখক হতে হলে মেধা ও সততার সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। যৌনসাহিত্যের স্বীকৃতি পৃথিবীতে থাকলে জান্নাতুন নাঈম প্রীতি সফল এবং তার মতো, যেমনি নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনও! কেউ বলেছেন, অসাধারণ লেখা! পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে সমর্থন দিচ্ছেন? আমরা বলবো, অসাধারণ সে অর্থে, যে অর্থে তসলিমা নাসরিন।

নারীবাদীদের চেতনা কী অধিক পুরুষ ধর্ষণ! এটাই কি নারীবাদীদের মূলকথা? কিসের যৌন হেনস্থা? অবিবাহিত ছাড়াও বুড়ো বুড়ো লোকদের সঙ্গে নিজ সম্মতিতে শুয়ে কিসের মর্যাদা ও অধিকার খোঁজা? আর কেন সৃষ্টিকর্তা তাদের এই সুযোগকে বৈধতা দিল না এটা নিয়ে তাদের অভিযোগ! লেখিকাতো সৃষ্টিকর্তার নির্দেশনাকে অ্যাবাউট করেই অনেকের শয্যাশায়ী হয়েছেন। তারপরেও কোনো আবার বইয়ের উৎসর্গে লিখেছেন, ‘সব ধর্মের ঈশ্বরকে- যারা কেবল আমাদের যোনির ওপর খবরদারি করতে জন্মেছিলেন!’

অন্য যাদের কথা বইয়ে এনেছেন, তারা যদি কারো বেডশেয়ারিং করেও থাকে সে তো আর পাবলিকলী কান্নাকাটি করে না, ওমুক আমার সাথে হেন করেছে, তেন করেছে, এখন আমাকে চেনে না! কিংবা শোয়ার লিস্ট করে নিজেকে শত ভ্রমরের ফুল বলেও গর্ব করে বেড়ায় না। এটাই যদি আÍজীবনী হয়, তাহলে প্রীতিকে বলবো আপনার পূর্ণ শোয়ার লিস্টটা দিন, যে কেউ একটা বই লিখে ফেলবে!

জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইয়ে জান্নাতুন নাঈম প্রীতি কিছু মানুষের সঙ্গে তার নিজের জীবনের গল্প প্রকাশ করেছেন। একজন স্বনামধন্য চলচিত্র নির্মাতার সঙ্গে নিজের দৈহিক সম্পর্ক এবং তার কিছু যৌনসঙ্গীর নাম তিনি প্রকাশ করেছেন। চলচিত্র নির্মাতা যেসব মেয়ের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার গল্প প্রীতিকে বলেছিলেন, সেই গল্পগুলো কি তিনি প্রীতিকে জনসমক্ষে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন? তিনি যদি সে অনুমতি তাকে দিয়েও থাকেন, যে মেয়েদের কথা তিনি বলেছেন সেই মেয়েরা কি তাকে তা প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন? অথবা আইন কি প্রীতিকে এসব প্রকাশের অনুমতি দেয়? ধরে নিলাম আইন সে অনুমতি না দিয়ে কণ্ঠ রোধ করতে চায়; রাষ্ট্র আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। কিন্তু নৈতিকতা বা আমাদের সাধারণ নীতিবোধ কি আমাদেরকে সে অধিকার দেয়? লেখিকা নিজে বহু পুরুষের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন, তাই বলে কি অন্যদের নাম প্রকাশ করতে হবে? বিষয়টি এমন হয়ে গেলো না, আমি একাই তো না, অন্য মেয়েরাও তো এরকম!

প্রীতি অনেক কম বয়স থেকেই আলোচিত তার লেখালেখি ও ডিফারেন্ট সেক্সি এক্টিভিজমের জন্য। তার বিরুদ্ধে ডিএসএর মামলা হয়েছে এবং প্যারিসে গিয়ে মামলা-হুমকি থেকে আÍগোপনে রয়েছেন। অন্যের প্রাইভেসি লিক করার পেছনেও স্বার্থ আছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পোক্ত করতে, ফ্রান্সে সেটেল হতে সে এটা করতে পারে। এখন সে দেখাবে বাংলাদেশে কোন ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, তার জীবনের নিরাপত্তা নেই। এটা খুব সহজ হিসাব। পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরে সেটা নিয়ে অভিযোগ করাকে সুস্থ মানসিকতা মনে করা যায়? মেয়েদের চরিত্র হনন করতে এ সমাজ এমনিতেই মুখিয়ে থাকে। এখন বাইরে কাজ করা মেয়েদের সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকলো? প্রীতি মেয়েদের জন্য আরও বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দিলো নাতো?

প্রাইভেসি হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ব্যক্তির একান্ত বিষয়। ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁস করার বিষয়ে সংবিধানে মানা আছে। এ বিষয় প্রতি বছর ২৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক তথ্য সুরক্ষা দিবস পালন করা হয়। ব্যক্তির নিভৃতি বা গোপনীয়তার মূল্য কত হতে পারে তা গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে দাপটশালী বিপণন প্রতিষ্ঠান আমাজনকে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করায় ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার জরিমানা করার পর বোঝা গেছে। আমাদের সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার বলে স্বীকৃত। পশ্চিমা বিশ্বে প্রাইভেসি ভাঙ্গা খুবই বড় ক্রিমিনাল অফেন্স।

বিবাহিত ব্যারিস্টারের কাছে প্রেম করতে গিয়ে প্রতারিত হবার বোধ নিয়ে কথা প্রীতি বলতেই পারেন। কিন্তু নিহত মেজরের বান্ধবী যে কিনা তার নিজের বান্ধবীও ছিল, সে বান্ধবী মেজরের দ্বারা প্রেগন্যান্ট হওয়ার গল্প বলার মর্ম কী? কিংবা বিখ্যাত এক শয্যাসঙ্গী যখন অন্য বিখ্যাত শয্যাসঙ্গিনীর বিষয়ে আলাপ করছেন, তা যদি কোনো মাত্রায় অপলাপ হয়, তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে? প্রীতি যার সঙ্গে ‘শয্যা ভাগ’ করেছেন বলে দাবি করেছেন, তিনি বিনোদনজগতের ‘সেলিব্রিটি’র একজন। লেখকের দাবি, অন্তরঙ্গ মুহূর্তেই সেই পুরুষ সঙ্গীটি তাকে জানিয়েছিলেন, ৫০ জনের বেশি নারীর সঙ্গে তার এ ধরনের সম্পর্ক হয়েছে। লেখকের দাবি অনুযায়ী, সেই অনেক নারীর মধ্যে এমন একাধিক নারীর নাম পুরুষ সঙ্গীটি তাকে বলেছিলেন, যাদের সবাই একনামে চেনেন। যার প্রতি প্রীতির কোনো কারণে বিদ্বেষ আছে তিনি তারই যৌনজীবন ঘেটেছেন। যার প্রতি তেমন বিদ্বেষ নেই, তার কথা গোপন করেছেন।

বইটিতে ‘সেক্স স্টোরি’ নিবন্ধ শুরুর বাক্যটি হল, “সেই ষোলো বছর বয়সে প্রথম রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্ট মোড়ে দাঁড়িয়ে চুমু খেয়েছিলাম এক প্রেমিককে।” সেই প্রেমিকটির নাম প্রকাশ করেননি প্রীতি। প্রীতি কলেজে জীবনের তার এক গোপন প্রেমিকের নামও গোপন রেখেছেন। এজজন বিখ্যাত পার্টনারকে ডিফেন্ড করার দায়ে ৬ জন নারীর প্রতি তিনি রীতিমতো বিষোদগার করেছেন। তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, হিংসুক নারীটি ঈর্ষায় মাখামাখি হয়ে গালাগাল দিতেও ছাড়েনি আমাকে। এমনকি এক স্থপতি বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম এই নারীটি কী চমৎকার ‘সংগমপটু’। প্রীতি সেই নারী সাংবাদিকের নাম লিখেছেন কিন্তু তার স্থপতি বন্ধুর নাম লেখেননি। কেন তার নাম প্রকাশ করেননি? কোনটা প্রাইভেট থাকবে, আর কোনটা পাবলিক হবে, কিসের ভিত্তিতে তিনি নির্ধারণ করেছেন? লেখকের উদ্দেশ্য পরিস্কার এবং প্রকাশের সততা প্রশ্নবিদ্ধ। নিজের যৌন জীবনের প্রায় ৩৮ জন পার্টনারের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম তিনি প্রকাশ করেছেন এবং অবশ্যই তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে।

যদিও প্রীতি কতিপয় নষ্ট পুরুষের কথা সাহস করে লিখেছে, লেখায় ভঙ্গিও আছে, তবে ফিলোসোফিতে সে নব্য তসলিমা নাসরিন। বাই দা ওয়ে প্রীতি যেই লেভেলের মানুষ সেই লেভেলের লেখাই ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন। যা সমাজের অন্তকথার বাস্তব চিত্র। সামাজিক নষ্ট জীবগুলোর মুখোশ উন্মোচন। এর আগে কিছু নষ্টের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন তসলিমা নাসরিন।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net