মুসলিমদের অনৈক্যের কারণ ও প্রতিকার

::
প্রকাশ: ২ years ago

বিলাল হোসেন মাহিনী:
আরবি ‘ইকামাতে দ্বীন’ এর বাংলা অর্থ ইসলামি জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর বিধান (দ্বীন) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তি ও সংগঠন। কিন্তু মুশকিল হলো, এই দায়ীদের মধ্যে নানা মতানৈক্য ও অনৈক্য। আমরা জানি আল্লাহর প্রেরিত কিতাব (আল কুরআন) একটি এবং তাঁর প্রেরিত রাসুলও একজন (হযরত মুহাম্মদ সা.)। নবী সা. হলেন কুরআনের মানচিত্র স্বরূপ। তিনি নিজ জীবনে পবিত্র কুরআন বাস্তবায়ন করে গেছেন।
সুতরাং দ্বীন প্রতিষ্ঠার ধারাও একটি। তবে কেনো এতো দ্বন্দ্ব এতো দল-উপদল?

আসুন সবিস্তারে জেনে নিই, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ থাকার পথ ও পন্থা কী কী।

দ্বীনকে নিজ জীবন ও সমাজে বাস্তবায়নের সাথে জামায়াত তথা সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের সম্পর্ককে সালাত ও ওযুর সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায়।

আল্লাহ পাক সালাত আদায়ের পূর্বশর্ত হিসেবে ওযু ফরয করেছেন। সালাত হলো আসল ফরয। ঐ ফরযটি ওযু ছাড়া হয়না বলেই ওযু ফরয। একইভাবে ঐক্যবদ্ধ জিন্দেগী ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজই আসল ফরয। ঐ ফরযের প্রয়োজনেই সংঘবদ্ধ জীবন যাপন ওয়াজিব করা হয়েছে।

 

দ্বীন প্রতিষ্ঠার মর্মকথা :
দ্বীন ক্বায়েমের প্রচেষ্টাকে ইক্বামাতে দ্বীন বলা হয়। সহজ কথায়- আল্লাহর বিধিনিষেধ ব্যক্তি, সমাজ ও বিশ্বব্যাপি বাস্তবায়নের জন্য যে প্রাণান্তকর চেষ্টা-প্রচেষ্টা, তাকে ইকামাতে দ্বীন বলা হয়।
আরবি ইকামাত অর্থ স্থির হওয়া/ করা, দাঁড়ানো, সোজা হওয়া, বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি। এবং দ্বীন অর্থ বিধান। মানে আল্লাহর বিধান প্রাতিষ্ঠার নাম হলো ইকামাতে দ্বীন।
আর দ্বীন ক্বায়েম বলতে বুঝায় কোন জনপদে দ্বীন ইসলাম বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ বিধি-বিধান অনুসরণ ও বাস্তবায়নের পথে কোন প্রকারের বাধা ও অন্তরায় না থাকা ইত্যাদি।

কোন দেশে যদি ইসলামী অনুশাসন বা কুরআন সুন্নাহর বিপরীত আইন চালু থাকে তাহলে জীবন যাপনের আন্তরিক নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও ঐ আইনের কারণে তা মানা সম্ভব হয় না। কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ইসলামী আদর্শের বিপরীত কিছু শেখায় এবং ইসলাম না শেখায় তাহলে সেখানেও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মতো মন মানসিকতা তৈরি হয় না। যে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিবেশ ইসলামী আদর্শের বিপরীত, সেখানেও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী অনুশাসন ও অর্থনীতি মেনে চলা সম্ভব নয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ জীবনের চাবিকাঠি যাদের হাতে, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সর্বসাধারণ তাদের অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সমাজের এই নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী যারা দেশ, জাতি ও সমাজ জীবনের স্নায়ুকেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে তারা যদি ইসলামী আদর্শ বিরোধী হয় তাহলে ও সেই সমাজের মানুষ ইসলাম অনুসরণ করার সুযোগ পায় না। ব্যক্তি জীবনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যতটা দ্বীন (ধর্ম) পালন হয় তা পরিপূর্ণ দ্বীনের তুলনায় কিছুই নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামগ্রিক ও পরিপূর্ণ দ্বীন পরিপালন তো দূরের কথা, আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোরও হক আদায় করা হয় না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সালাত আদায় হতে পারে কিন্তু কায়েম (বাস্তবায়ন) হয় না। অথচ সালাত কায়েমেরই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আদায়ের নয়। এমনিভাবে যাকাত আদায়ও সঠিক অর্থে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হতে পারে না। সাওম তো এমন একটা পরিবেশ দাবী করে যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্ভব নয়। হজ্জের ব্যাপারটা আরও জটিল।

সালাত, সাওম এবং যাকাত তো ব্যক্তি ইচ্ছে করলে সঠিকভাবে হোক বা নাই হোক তবুও আদায় করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ছাড়পত্র ছাড়া হজ্জের সুযোগ বর্তমান ব্যবস্থায় না থাকায় ব্যক্তি ইচ্ছে করলেও হজ্জের ফরজ আদায় করতে পারছে না। সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) আদেশ-নিষেধের কোনো একটিও পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিক জীবনে আমরা সুদ বর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি না, আল্লাহর বিধান সমাজে না থাকায়।

সমাজ জীবনে বেপর্দা-বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনা থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। যেনা-ব্যভিচার শরীয়তে নিষিদ্ধ হলেও আল্লাহর বিধান না থাকায় রাষ্ট্রীয় আইনে এর জন্যে লাইসেন্স দেয়া হয়।

চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন-খারাবী প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ ও নৈতিকতা বিরোধী কাজের মূলোৎপাটন করে সৎকাজের প্রসার ঘটানোর সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যায়, দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না থাকায়।

যেখানে দেশে দ্বীনের আনুষ্ঠানিক ও সামগ্রিক দিক ও বিভাগের অনুসরণ ও বাস্তবায়নে উল্লিখিত কোন বাধা নেই বরং দ্বীনের বিপরীত কিছুর পথে অনুরূপ অন্তরায় আছে সেখানেই দ্বীন (আল্লাহর বিধান) বলবৎ আছে বলতে হবে। এভাবে দ্বীন (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। সব নবী রাসুলেরই দায়িত্ব ছিল দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা করা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে –
“তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না।”
(সূরা শুরাঃ ১৩)

দেখুন, উপরোক্ত আয়াতের শেষাংশে অনৈক্য সৃষ্টি না করতে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা একে অপরকে সহ্য করতে পারছি না।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ ও পদ্ধতি নানামূখী হতে পারে। অর্থৎ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপি হাজারো সংগঠন থাকতে পারে কিন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার কেনো? অনৈক্য কেনো?
মূলত: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে ইসলামি দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজি করে বলে মনে করেন ইসলামি স্কলারগণ।

হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেন, দুনিয়া ও আখিরাতে আমি ‘ঈসা (আঃ)-এর সর্বাধিক নিকটবর্তী। লোকেরা বলল, এটি কীভাবে হে আল্লাহর রসুল? তখন তিনি বললেনঃ নবীগণ একই পিতার সন্তানের মতো। তাঁদের মাতা ভিন্ন। তাদের দ্বীন একটিই। আর তার এবং আমার মাঝে কোন নবীও নেই। (ই.ফা. ৫৯২০, ই.সে. ৫৯৫৮)
মুসলিম ৬০২৬)

 

ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের গুরুত্ব:
Islam is the perfect & complete code of life. মানুষ সামাজিক জীব। ইসলাম মানুষেরই জন্য। তাই ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই এমন বিধান দিয়েছে যা মানব সমাজের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। তাই ব্যক্তিকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ইসলাম এতো বিস্তারিত বিধি-বিধান দিয়েছে।

ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত একটি ভারসাম্যপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ বিধানই মানব জাতির কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এ জাতীয় বিধান একমাত্র আল্লাহই দিতে সক্ষম। তাই ইসলামই একমাত্র বিশ্বজনীন বিধান।

ঐ পূর্নাঙ্গ বিধানকে মানব সমাজে চালু করার দায়িত্ব দিয়েই রাসুল (সা.)-কে পাঠানো হয়েছে। সমাজ গঠনের কাজ সামাজিক প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য রাসূলের চেয়ে বেশী যোগ্য কেই হতে পারে না। কিন্তু সব রাসূলের জীবনে ইসলাম বিজয়ী হয়নি। কারণ ইসলামকে বিজয়ী করার যোগ্য একদল লোক যোগাড় না হলে যোগ্যতম রাসুলের পক্ষেও এ কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়।

এ কারণেই প্রত্যেক রাসুল দুনিয়ার সকল মানুষকে দীনের দাওয়াত দেয়ার পর যারা সাড়া দিয়েছেন, তাদেরকে ﻓَﺎﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺃَﻃِﻴﻌُﻮﻥِ (আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর) বলে দাওয়াতও দিয়েছেন।

এর দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, রাসুলের প্রতি ঈমান রাখা যেমন ফরয ঈমানদারদের সংঘবদ্ধ হওয়াও তেমনি ফরয।
এ জন্য জামায়াতের সাথে সালাত আদায় ওয়াজিব করা হয়েছে।

 

আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ:
পবিত্র কুরআনে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের গুরুত্ব বর্ণনা করে বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। উক্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা মুসলিম উম্মাহর জন্য ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন-
‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু (দ্বীন)কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত রয়েছে তা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে (উদারতা) প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, তারপরে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে এবং তোমরা অনলকুণ্ডের ধারে ছিলে, অনন্তর তিনিই তোমাদের ওটা হতে উদ্ধার করেছেন; এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করেন যেন তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হও’।
(সুরা আলে ইমরানঃ ১০৩)

তিনি আরও বলেন-
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল বা সংঘ থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎ কর্মের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভাল কাজের এবং নিষেধ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হ’ল সফলকাম’
(সুরা আলে ইমরানঃ ১০৪)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন-
‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দিবে এবং আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনবে’
(সুরা আলে ইমরানঃ ১১০)

রাসুল (সা.) ঐক্যবদ্ধ জিন্দেগীর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন:
হযরত উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ: নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা সংঘবদ্ধ হও এবং শতধা-বিভক্ত হয়ো না। কারণ শয়তান একাকীর সাথী হয় এবং দু’জন থেকে অধিক দূরে থাকে। আর যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ জান্নাত চায়, সে ব্যক্তির উচিত ঐক্যে শামিল হওয়া।”
(কিতাবুস সুন্নাহ, শায়বানী ৮৮)

নবী সা. আরও বলেন-
‘আমি তোমাদেরকে এমন পাঁচটি কথার হুকুম দিচ্ছি যা আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন –১. সংগঠনবদ্ধ হওয়া, ২. নেতার কথা শুনা, ৩. আনুগত্য করা, ৪.হিজরত করা ও ৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি)

তিনি সা. আরও বলেন-
‘যখন তিন জন লোক সফরে যাও তখন তোমাদের একজনকে আমীর বানাও।’
(আবূ দাউদ ২৬০৮-৯)

রাসুল সা. বলেন-
‘যে ব্যক্তি ইসলামি সংঘ পরিত্যাগ করল সে ইসলামের শিকল তার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলল।’
(মুসনাদে আহমাদ ও আবূ দাউদ ৪৭৫৮)

হাদিসে আরও কঠিন করে বলা হয়েছে –
“যেই ব্যক্তি ইসলামি সংঘ থেকে বিচ্ছিন্ন (একাকী) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।”
(মুসলিম ১৮৫১)

এখন কথা হলো, যারা তথাকথিত ইসলামি দল করেন না, তারা কি জাহান্নামি?

উত্তরে বিশ্বের আলেম ওলামা ও মুফতিয়ে কেরাম বলেন, এখানে জামায়াত তথা সংঘ থেকে বিছিন্ন হওয়া বলতে প্রচলিত ইসলামি রাজনৈতিক দল করা বা না করা উদ্দেশ্য নয়। বরং মুসলিম ইমামের অধিনস্ত থাকা উদ্দেশ্য।

তবে মুসলিম জীবনে সংঘবদ্ধ থাকার এ বিরাট গুরুত্বের দরুনই ফরয নামায জামায়াতে আদায় করার জন্য এতো তাগিদ হাদীসে রয়েছে। যারা নামাযের জামায়াতে আসেনা রাসুল (সা.) তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন।

পবিত্র কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন একথাই প্রমাণ করে যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা ওয়াজিব।

 

একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও তার সমাধান :
দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা ওয়াজিব। তবে এর ব্যাখ্যা ও বোঝার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একদল মনে করেন, ইকামতে দীন বলতে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইসলাহ বুঝায়। আরেক দলের মত হলো- দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা।

তবে, বিশ্ব ইসলামি স্কলার ও ফোকাহায়ে কেরামের মতে দুইটার সমন্বয় হ‌লো ‘ইকামতে দ্বীন’। একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই।

তাওহিদ ও ব্যক্তি ইসলাহ ছাড়া সামগ্রিক দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাওহিদের দাবিও পরিপূর্ণভা‌বে আদায় করা সম্ভব নয়।

এখন, একদল যদি তাওহিদ ও ব্যক্তি ইসলাহের কাজ করেন । আরেকদল যদি তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে প্রথম দল দ্বিতীয় দলের সম্পূরক এবং সহযোগী। উভয় দল‌ই দ্বীনের দাঈ, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং দু’টাই ইকামতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু তাওহিদের দাওয়াত দিতে গিয়ে কেউ যদি কাউকে বৃহৎ ইসলামি সংগঠনে যোগ দিতে নিষেধ করেন বা এটাকে যথেষ্ট মনে করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন‌কে বিজয়ী করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন তাহলে তিনি মূলত: ইকামতে দ্বীনের‌ই বিরোধিতা করলেন।

আর একটা কথা, সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে গিয়ে ইসলামে যে বাইয়াত (শপথ) নেওয়া হয় তা সাংগঠনিক শৃঙ্খলার জন্য এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বাইয়াত এখানে উদ্দেশ্য নয়। এই বাইয়াতের ব্যাপারে শরিয়তের কোনো হুকম‌ও লাগানো ঠিক হবে না। তাই বাইয়াত ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে জাহেলিয়াতি মৃত্যু হবে, এমন কথা সঠিক নয়।

আল্লাহ তায়ালা গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। (সূরা আল ইমরান-১০৩)

কিন্তু আমরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে ফাসিকি, নেফাকি, কুফরি, গোমরাহী ইত্যাদি তোকমা লাগিয়ে ফেরকাবন্দি হয়ে পড়ে আছি।

এটা আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী। কিন্তু দ্বীন পালনের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করা শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। তাই মুসলিমদের যদি এক দল আরেক দলের বিরোধিতা না করে এবং নিজের জাত, গোষ্ঠী ও বংশ আলাদা না করে একে অপরের সম্পূরক, সহযোগী ও ভ্রাতৃত্বসূলভ সম্পর্ক রেখে কাজ করে তাহলে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়েও মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে দীন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচে’ বড় অন্তরায় হলো রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা ও প্রতিহিংসা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক: পরীক্ষক, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাস্টার্স মাদরাসা, অভয়নগর যশোর।