মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়ন ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সুযোগ

::
প্রকাশ: ২ years ago

২০২৩ সালের ২২ মার্চ মিয়ানমার সরকার ঘোষণা করে যে তারা এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ থেকে ১,১৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন শুরু করবে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা এশিয়ার উদীয়মান শক্তি চীনের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার কারণে পাইলট প্রত্যাবাসন কর্মসূচি শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার আরেক আঞ্চলিক শক্তি ভারত এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয়।

মিয়ানমারে নৃশংস রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং কয়েক দশকের জাতিগত নিপীড়ন হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে ১৯৭০-এর দশক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। তহবিল, সংগঠন, আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং পর্যাপ্ত শরণার্থী নীতির অভাবে শরণার্থীদের জন্য বিপর্যয়কর মানবিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। উপরন্তু, মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার উপস্থিতি বাংলাদেশ এবং ভারতে বেশ কয়েকটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, দুটি দেশ ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব নাগরিকদের চাহিদা মেটাতে লড়াই করছে। বেশ কয়েকটি ভূরাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে এই প্রক্রিয়ায় আরও আগ্রহ দেখানো ভারতের পক্ষে উপকারী হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন এবং ভারতের কৌশলগত হিসাব

ভারত প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু সহায়তা প্রদান করলেও নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে সক্রিয় অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত  রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে (ইউএন) এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। প্রত্যাবাসনে অপারগতার কারণে ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যকার আন্তরিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে (ইউএন) এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই বেশ কিছু নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে।  ভারত সরকারের মতে, ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা চরমপন্থার ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শোষণ করতে পারে এবং আন্তঃসাম্প্রদায়িক সংঘাত উস্কে দিতে পারে। তদুপরি,  ভারতীয় জনসংখ্যার কিছু অংশ ভারতীয়  ভূখণ্ডে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতিতে অসন্তুষ্ট, এবং এইভাবে রোহিঙ্গারা ভারতের একটি সংবেদনশীল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

একইভাবে, দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট বাংলাদেশের জন্য চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আন্তঃজাতিক সংঘাত সহ বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা, যারা মূলত কক্সবাজার এর শরণার্থী শিবির  এবং ভাসানচর দ্বীপে কেন্দ্রীভূত, তারা মারাত্মক খাদ্য, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত এবং কমিউনিটি নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যা  বাংলাদেশ যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে । অতএব, এই সংকটের সমাধান বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির উত্স দূর করবে।

বাংলাদেশের সদিচ্ছা অর্জন, নিরাপত্তা খাতে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা আরও সহজতর করতে এবং চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের অব্যাহত নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ভারতের উচিত  প্রত্যাবাসনে সহায়তা করা। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ভৌগোলিক নৈকট্য দ্বারা নয়, ঐতিহাসিক বন্ধন, অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা এবং রাজনৈতিক সৌহার্দ্য দ্বারাও চিহ্নিত করা হয়।

বাংলাদেশ ভারতের ধারাবাহিকভাবে নির্ভরযোগ্য এবং স্বচ্ছ অংশীদার এবং সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে  জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির  ঘাঁটি ধ্বংস করে এবং তাদের নেতাদের ভারতে প্রত্যর্পণের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভারতীয় দমনকে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ ভারতকে সস্তা ট্রানজিট এবং ট্রান্স-শিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করেছে যাতে ভারত তার দূরবর্তী এবং স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে অবাধ প্রবেশাধিকার পায়। চীনের সঙ্গে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি জোটনিরপেক্ষ ও সমদূরত্বে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। মায়ানমারের বিপরীতে, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত  ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরিকল্পিত এবং সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখেছে। চীন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদার, তবে এটি ভারতের সাথে তার ঐতিহাসিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতে বাধা দেয়নি।

উপরন্তু, চীন ইতিমধ্যে মায়ানমারে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে শক্তিশালী সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বেইজিং ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, তাই চীনের প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্য ভারতেরও একইভাবে প্রচেষ্টা জোরদার করা উচিত। ভারত এমনকি এই ইস্যুতে চীনের সাথে একসাথে কাজ করতে পারে এবং এটি নয়াদিল্লিকে বেইজিংয়ের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ দিতে পারে। তদুপরি, ভারত যদি গ্লোবাল সাউথের দুটি উন্নয়নশীল দেশ মায়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করে সংকট সমাধানে সহায়তা করে তবে নয়াদিল্লি এই অঞ্চলে একটি উদীয়মান মহান শক্তি এবং নেট সুরক্ষা সরবরাহকারী হিসাবে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এবং গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে তার ভাবমূর্তি বাড়িয়ে তুলবে।

পরিশেষে, প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টায় সহায়তা করা মানবাধিকার ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া একটি মানবিক শক্তি হিসাবে ভারতের ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করবে  ।  ভারত যদি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদ ও মানবিক প্রত্যাবাসনে সফল হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভারতের প্রতি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সম্পৃক্ততায় প্রধান বাধা

স্পষ্টতই, ভারত তার ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে মায়ানমারের সাথে ভাল প্রতিবেশীসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, অস্ত্র ও মাদকের আন্তঃসীমান্ত চোরাচালান বন্ধ করতে, মায়ানমারের সমৃদ্ধ হাইড্রোকার্বন মজুদগুলিতে অ্যাক্সেস পেতে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ-পূর্ব  এশিয়ায় একটি স্থল করিডোর স্থাপনের জন্য ভারতের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ মায়ানমার প্রয়োজন  । ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সতর্ক হয়েছে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে, মিয়ানমার ভারতের চেয়ে চীনের সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; মায়ানমারের সামরিক সরকার মায়ানমারের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভারতীয় বিদ্রোহীদের সাথে একটি ‘গোপন সমঝোতায়’ পৌঁছেছে এবং সম্প্রতি তারা  ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে একটি বিদ্রোহী শিবিরে বোমা নিক্ষেপ করেছে।

মিয়ানমার বর্তমানে গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গারা নিরাপদ থাকবে কি না, তা একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত, রোহিঙ্গারা নিজেরাই  মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে  এবং বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকারও  তাদের প্রত্যাবাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অবশেষে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় জাতিগত রাখাইন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বলেছে, তারা  আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিরোধী নয়। সকল স্টেকহোল্ডারদের জোরালো সমর্থন ভারতের পক্ষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজতর করতে সহায়তা করা সহজ করে তুলবে।

উপসংহার

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য ভারতের কাছে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াসহজতর করার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেওয়া উচিত।  ভারতের উচিত তাতমাদোর ওপর তার প্রভাব ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে প্ররোচিত করা। উপরন্তু, চীনের বিকল্প হিসাবে ভারতের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা উপস্থাপন করা উচিত নয়। বরং চীনের প্রভাবের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একত্রে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করতে আরেকটি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে চীনের উদ্যোগে শুরু করা প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারে। পরিশেষে, ভারতের উচিত উত্তর রাখাইনের মানবিক পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সন্তোষজনক কিনা তা নিশ্চিত করা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য ভারতের কাছে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াসহজতর করার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সুবিধাজনক সম্পর্ক রয়েছে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের সমাধান করা উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থে রয়েছে। তাই ভারতের উচিত রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করা এবং এর সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করা।

লেখক: সুফিয়ান সিদ্দিকী, গবেষক ও ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট।