মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে তৎকালীন পুলিশ বাহিনী। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশের সদস্যরাই প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ জনগণের কাছাকাছি থেকে মডেল থেকে স্মার্ট হওয়ার পথে বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু এ বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য জনগণের বন্ধু হওয়ার স্বপ্নকে বারবার নানাভাবে সমালোচনার মুখে ফেলেছেন। তারা পুলিশের পোশাক পরে এবং পুলিশের নাম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন। অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছেন নারী কেলেঙ্কারিতে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নারীঘটিত কেলেঙ্কারি দেশজুড়ে সমালোচিত হয়েছে। এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে-পুলিশ কেন নারীতে আটকায়? অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ থেকে পুলিশ হওয়া অনেক কষ্টের। সমাজে যারা অপরাধী তাদের দমন করাই পুলিশের কাজ। সেই পুলিশ যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তা হলে পুলিশকে জনগণ মেনে নেবে না।
অতিসম্প্রতি ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের সঙ্গে ডিএমপির সদর দপ্তরে কর্মরত সানজিদা আফরিন নিপার অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সানজিদার স্বামী রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক মামুনের সঙ্গে এডিসি হারুনের দ্বন্দ্ব হয়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে আটক করে থানা হেফাজতে নিয়ে বেদম মারধর করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাহিনীতে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার পর হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত কয়েক বছরে এ ধরনের কেলেঙ্কারিতে যাদের নাম বেশি আলোচনায় এসেছে তাদের মধ্যে ডিআইজি মিজান, পুলিশ সুপার মুক্তার ও এডিসি সাকলায়েনের নাম উল্লেখযোগ্য।
এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কর্মসংস্থান ব্যাংকের কর্মকর্তা ইকো নামের এক নারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিয়ে করেন ডিআইজি মিজান। পরে ইকোকে শর্ত দেওয়া হয় ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিয়ের তথ্য গোপন রাখার। ইকো তা প্রকাশ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে মিজান পুলিশ পাঠিয়ে ইকোকে গ্রেফতার করান। ডিআইজি মিজান বগুড়া, রমনা ও মোহাম্মদপুর থানার পুলিশকে ব্যবহার করে ইকো ও তার পরিবারকে হয়রানি করেন। তল্লাশির নামে ইকোর লালমাটিয়ার বাসা তছনছ করে তার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, লেখাপড়া ও চাকরি-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিয়ে যায় পুলিশ।
বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশ কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ডিআইজি মিজানের আরও নারী কেলেঙ্কারির তথ্য পাওয়া যায় ওই সময়। এক সংবাদ পাঠিকাসহ কয়েক নারীর সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক থাকা দাবি করেন ইকো ও তার মা। মিজানের ফাঁদে পড়ে অনেক নারীর সংসার ভেঙেছে বলেও দাবি করেন তারা। এর প্রমাণ হিসেবে ফোনালাপের রেকর্ডও সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন তারা। এর জেরে এক পর্যায়ে ডিআইজি মিজানের অবৈধ অর্থ সম্পদের হিসাবের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে দুদক। ওই মামলায় তাকে ১৪ বছরের সাজা দেন আদালত।
২০১৯ সালের মে মাসে সুদানে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের কন্টিনজেন্টের কমান্ডার পুলিশ সুপার মোকতার হোসেনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক নারী কর্মকর্তার। সেখানে থাকা অবস্থায় ওই নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান তিনি। এসপি মোকতার দেশে আসার পর তাকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে বদলি করা হয়। দেশে ফিরে ২০২১ সালের ১২ আগস্ট ওই নারী মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করলে তা মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে থানাকে নির্দেশ দেন ঢাকার একটি আদালত।
২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর দুপুরে আসামি বাদীর বাসায় গিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন পরে এবং ভুয়া বিয়ে করে আরও বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেন। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার তাগিদ দিলে মোকতার হোসেন বাদীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং তাকে এড়িয়ে যেতে থাকেন।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ অফিস কাম বাসার একটি কক্ষে মেয়েদের নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় সহকারী পুলিশ সুপার মোহা. আবদুর রকিব খানকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল সার্কেলে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে অফিস কাম বাসার একটি কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদের নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসার অভিযোগ ওঠে।
২০২১ সালে আলোচিত অভিনেত্রী পরী মণির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় সামনে আসার পর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েনকে। পরে তাকে মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়। এর আগে পরী মণির বিরুদ্ধে র্যাবের করা একটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ওই মামলার সূত্র ধরেই পরী মণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এডিসি সাকলায়েনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জানান, দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মূল কাজটা পুলিশ করে থাকে। পুলিশের কার্যক্রমের একটা ইথিকস আছে এবং এই ইথিকস অনুযায়ী সবকিছুই কিন্তু তাদের সেখানো হয়।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, একজন মানুষের পুলিশ হয়ে ওঠা খুব কঠিন কাজ। এখন পুলিশ হয়ে ওঠাটা কিংবা যে যে পেশায় যাক না কেন, সেই পেশার নৈতিক মানদণ্ডে নিজেকে গড়ে তোলাটাই খুব কঠিন কাজ, সহজ নয়।
কিন্তু আমাদের দেশে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা পেশাগত নৈপুণ্য অর্জন, জবাবদিহি বজায় রাখা-এ বিষয়গুলো অতীতেও দেখেছি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা বা মূল্যায়ন করা হয়নি।
ঢাবির এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, পুলিশের মধ্যেও নানা ধরনের গ্রুপিং বলুন বা লিয়াজোঁ মেইনটেন বলুন অথবা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে বলুন-যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে পুলিশের একটা যোগসাজশ তৈরি হয়। সব মিলিয়ে পুলিশের মধ্যে যারা পেশাদারিত্বের পরিবর্তে অপেশাদারিত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লোভ-লালসা তৈরি হয়। সেটি কারও ক্ষেত্রে অর্থের প্রতি, কারও ক্ষেত্রে নারীর প্রতি, আবার কারও মধ্যে ক্ষমতার প্রভাব দেখানো। আমরা গত দুয়েক বছরে কয়েকটি ঘটনা দেখলাম। নৈতিক স্খলনের কারণে পেশাদারত্ব হারিয়ে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন পুলিশের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে এডিসি হারুন, এসপি মোকতার বা এডিসি সাকলায়েন কিংবা অন্য যাদের কথাই বলুন তারা আদর্শ ও নীতিবান পুলিশ হয়ে উঠতে পারেননি। শুধু নারী কেলেঙ্কারিই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুলিশের এমন নীতি-আদর্শচ্যুতির উদাহরণ আছে। তারা মনে করেছেন, একটা সুযোগ যেহেতু পেয়েছি সেটা কাজে লাগাই। তারা মনে করেছেন, আমি পুলিশ, আমাকে কোথাও জবাবদিহি করতে হবে না, কেউ আমার কাছে জবাবদিহি চাইবেও না। কারণ তারা আমার পরিচয়, পোশাক ও অস্ত্রকে ভয় পাবে। এসব কারণেই কখনো কখনো তারা জোর করেই কোনো সহকর্মী অথবা অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। আবার কখনো কখনো ওই পুলিশ ও নারী দুজনই নিজের ইচ্ছায় সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তাদের এই নৈতিক স্খলনের কারণে তৃতীয় কেউ ভিকটিম হয়েছে। এমনকি কেউ সহিংসতার শিকার হয়েছে, আত্মহত্যা করতে হয়েছে এবং এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ দীর্ঘদিন ধরেই জনগণের বন্ধু হতে চাচ্ছে, তারা জনবান্ধন হতে চাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটার বিপক্ষে। আমি মনে করি, পুলিশ পুলিশই হওয়া উচিত। তিনি আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারগুলো দেখবেন। তার বন্ধু হওয়ারও দরকার নেই, জনবান্ধন হওয়ারও দরকার নেই। তিনি (পুলিশ) যদি তার জায়গায় ঠিক থাকেন তা হলেই জনগণ খুশি। আগ বাড়িয়ে বন্ধু হতে গেলেই বিপদ। তারপরও তারা এটা করতে চায়, ভালো। কিন্তু হঠাৎ যখন একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়, তখন আর জনগণের মধ্যে সেই বন্ধুত্বের জায়গাটা থাকে না। যদিও এসব ঘটনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির দায়ভার প্রতিষ্ঠান নেবে না। কিন্তু একজন ব্যক্তি পুলিশের নিয়োগ থেকে শুরু করে তার পদায়ন, দায়িত্ব সবকিছুরই দায় যদি প্রতিষ্ঠান নিতে পারে তা হলে তার অপকর্মের দায়টা নিতে অসুবিধা কোথায়? সে তো এই বাহিনীর পরিচয়-পোশাকেই অপকর্মটা করার সাহস দেখিয়ে থাকে। বরং এমন দায়হীন মন্তব্যের কারণে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে। পুলিশের প্রতি আস্থার সংকট আরও বেশি দীর্ঘায়িত হয়। উপরন্তু অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা না হওয়ায় এবং তাদের শাস্তির বিষয়টা ডিপার্টমেন্টের তদন্ত বা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশের পেশায় থেকে তার সহকর্মী নারীর সঙ্গে কোনো অনৈতিক কাজের সম্পৃক্ততা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা অতীতে দেখেছি যেকোনো পুলিশ সদস্য এ ধরনের অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বাবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি যেটা ঘটেছে তার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদি নারী পুলিশের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা প্রমাণিত হয় তা হলে অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তির দায় পুলিশ কখনোই মেনে নেবে না। পুলিশ বাহিনী আগের চেয়ে অনেক আধুনিক এবং তথ্যপ্রযুক্তিসম্পন্ন। চাইলেই অপরাধ করে পার পাবে না।
সৌজন্যে: দৈনিক সময়ের আলো।