গত ১৬ জুন জনপ্রিয় ভারতীয় পত্রিকা মিলেনিয়াম পোস্টে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপথগামী উদ্যোগ’ শিরোনামে একটি মতামত লিখেন ভারতীয় সাংবাদিক এবিএম নাসির। বাংলাদেশের সাথে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে লিখাটির চম্বুক অংশ অনুবাদ করে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে টুইটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। নতুন ভিসানীতিতে যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুন্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকবে তাদের উপর মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হবে।
এই নতুন ভিসানীতিটি খুবই আকস্মিক এবং দিকনির্দেশনা হীন। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব অনেকটা “আপনি হয় আমাদের সাথে না আমাদের বিরুদ্ধে…”। এরকম দ্বিধা ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে দেয়া এই নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম প্রধান এবং প্রথাগত উদার গণতন্ত্রের দেশে তথাকথিত সুষ্ঠু নির্বাচন অর্জনের লক্ষ্যে অস্থায়ী সমাধান মাত্র।
বেশ কয়েকটি কারণেই এই মার্কিন নীতি আকস্মিক এবং লক্ষ্যহীন।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন এমন দ্বিধা ও সন্দেহের মধ্যে থাকে তখন আফগানিস্তান এবং ইরাকের মতই অপমানজনক পশ্চাদপসরণের মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ২০ বছরে ২.৩১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এটিই প্রমাণ করে যে, অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের প্রচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কারণ যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে সফল হয়নি। বছরের পর বছর ধরে সংখ্যালঘু ভোটারদের দমন, ভোট কর্মীদের বিরুদ্ধে হুমকি, বাক-বিতণ্ডা, ভোট প্রদানের জেলায় কারচুপি এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত করা ইত্যাদি অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও রয়েছে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দেশের ৪০ শতাংশ জনগণ ২০২০ এর নির্বাচনকে সুষ্ঠু মনে করে না, সেখানে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তারা কিভাবে নির্ধারন করবে? অন্য একটি জরিপে, প্রায় ৬১ শতাংশ রিপাবলিকান জো বিডেনের প্রেসিডেন্সির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০২০ সালের নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন ভিসা নীতি বাস্তবায়নের সময় যুক্তরাষ্ট্র কি নির্বাচনে হেরে যাওয়াদের মতামতও বিবেচনা করবে?
তৃতীয়ত, ধরা যাক নতুন মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা থেকে পরাজিত রাজনৈতিক দলের ভোটার ও সমর্থকদের নিরাপত্তা কি তারা নিশ্চিত করতে পারবে? ২০০১ সালের অক্টোবরে সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াত-ই-ইসলামী নেতৃত্বাধীন ইসলামী জোটের জয়ের পর হিন্দুদের উপর নজিরবিহীন অত্যাচার নেমে আসে। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার ফলে তাদের টার্গেট করা হয়েছিল এবং লুটপাট, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ এবং হিন্দুদের তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদসহ নানাভাবে তাদের অত্যাচার করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে, কোন কোন ক্ষেত্রে জোট নেতাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চলতে থাকে।
চতুর্থ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন “উদার গণতন্ত্রের” একমাত্র উপাদান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, এমনকি বাংলাদেশের কিছু সুশীল সমাজ গোষ্ঠীও আইনের বিধি, ক্ষমতা পৃথকীকরণ এবং বাকস্বাধীনতা, সমাবেশ, ধর্ম এবং সম্পত্তির অধিকারের সুরক্ষার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হয় না। সুশীল সমাজের একদল অসন্তুষ্ট সদস্য যারা প্রায়শই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমর্থন করে বলে গলা ফাটায় তারাই আবার এক-এগারো’র অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করেছিল এবং রাজনীতিতে নির্মুল করার জন্য ‘মাইনাস-টু থিওরি’ সমর্থন করেছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন একটি বিশাল বিক্ষোভ এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।
সবশেষে, যদি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ২০১২ সালের মিশরীয় নির্বাচনের মতো একটি মৌলবাদী ইসলামী জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে? মিশরে একটি অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসি ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সহযোগী এবং ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা। তিনি গণতান্ত্রিক উপায় ব্যবহার করে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তিতে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, একজন সামরিক স্বৈরশাসক তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে টুইটারে অবাঞ্ছিত নীতি ঘোষণা না করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেটি করা প্রয়োজন তা হল:
১। একটি স্বচ্ছ মূল্যায়ন করা। “উদার গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করতে একটি টেকসই কৌশল প্রণয়ন করা এবং লবিং গ্রুপগুলো এড়িয়ে চলা যারা নির্বাচন ব্যাহত করা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত হতে পারে।
২। নির্বাচনে পরাজিত দল ও সংখ্যালঘুদের সমর্থকদের নির্বাচন-পরবর্তী নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৩। ২০১৩-১৫ সালে চরমপন্থী ইসলামি সংগঠনগুলির দ্বারা ব্লগার হত্যাকাণ্ড ও তাদের উপর ব্যাপক আক্রমণের পর ইউরোপ এবং আমেরিকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া শত শত ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা৷
দ্বিধা ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা বর্তমান নীতি ব্যর্থ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীন এবং চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তাদের প্রভাব হারাতে পারে।
মূল লেখা: https://www.millenniumpost.in/opinion/a-wayward-initiative-522335
অনুবাদ: ইরিনা হক; সুইডেন প্রবাসী গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।